মো. শহিদুল ইসলাম
তিস্তা নদী উত্তরবঙ্গ দিয়ে বয়ে চলা একটি বিপর্যস্ত নদী। বিপর্যস্ত এই অর্থে যে, নদীটি এই এলাকার জনপদের জন্য দিনকেদিন অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠছে। বিশেষ করে নদীটির পাশে অবস্থিত চারটি জেলা; কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুরের বিভিন্ন অংশে প্রতিবছর নিয়মিত কিংবা হঠাৎ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি হয়ে থাকে। উত্তরের এই অঞ্চলটিতে প্রতিবছরই তিস্তা নদী দ্বারা প্রভাবিত বন্যার ফলে ফসল, পশু-প্রাণী, রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতিসহ মানুষেরও প্রাণহানি ঘটে থাকে।
কিছুদিন আগেও অসময়ে হঠাৎ বন্যায় তিস্তা ঘেরা এই অঞ্চলটি মারাত্মক ক্ষতির কবলে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় আন্তঃজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঘর-বাড়ি, ফসল, প্রাণিসম্পদ ইত্যাদির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ফলে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়ে পড়ে পাঠ গ্রহণ হতে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে এই বন্যার ফলে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা।
সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত বাংলাদেশের এই অঞ্চলটি অতি বন্যা কিংবা বন্যা কবলিত হওয়া একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তার ওপর তিস্তার মত নদীর অবস্থানের ফলে উজান বেয়ে আসা পানি দ্রুত নিষ্কাশন হয়ে বন্যা সংগঠন ব্যাহত হবে এটিই স্বাভাবিক এবং এটিই হওয়ার কথা। কিন্তু তিস্তা নদীই উল্টো বন্যার সৃষ্টি করে আসছে দিনের পর দিন। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো; নদীটির গভীরতা কমে যাওয়া এবং নদী পাড় ভাঙ্গন যার ফলে উজান থেকে আসা পানির ঢল সামলাতে পারে না নদীটি এবং মুহূর্তেই নদীপাড় প্লাবিত হয়ে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। সাধারণ মানুষের অসচেতনতা ও তিস্তা নদীকেন্দ্রিক যথাযথ পরিকল্পনার অভাবেই নদীটি দিন দিন এই অঞ্চলের জনপদসমূহের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িঁয়েছে। খুবই দুঃখের বিষয় যে, সামান্য কিছু স্থান ছাড়া প্রায় সবস্থানেই নদীপাড়ের নির্দিষ্ট সীমানা নেই। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অকার্যকর পদক্ষেপ এবং নদীপাড়ের মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে নদীর দুই পাড়েই নির্দিষ্ট সীমানা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। যার ফলে অতি অল্পবৃষ্টি কিংবা হঠাৎ উজান থেকে বেয়ে আসা সামান্য পানি প্রবাহেও নদীপাড় প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে থাকে। আরো সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বছরের অধিকাংশ সময়ে নদীটির নাব্যতাহীনতার কারণে নদীপাড় এবং তৎসংলগ্ন জায়গাসমূহের মাটি দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে যা হঠাৎ পানি প্রবাহে খুব দ্রুতই ভেঙ্গে পড়ে যা যেকোন নদীর সঠিক বিন্যাস বিনষ্ট করে দেয় সহজেই। আর এমন পরিস্থিতিতে যেকোন নদীই উপকারের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি করবে এটিই স্বাভাবিক। বর্তমানে তিস্তা নদীর এমন অবস্থায়ই লক্ষণীয়।
সুষ্ঠু নদী ব্যবস্থাপনায়ই কেবল কোন নদ বা নদীকে কোন অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষ সহায়ক করে তুলতে পারে। তিস্তা নদীর বিষয়ে খুব দ্রুতই কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনামাফিক সার্বিক নদী বৈচিত্র ফিরিয়ে আনা গেলে উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলটি প্রতিবছর সংঘটিত বন্যা থেকে রক্ষা পাবার পাশাপাশি আরো অনেক সুফল পাবে। কৃষি সেচ, মৎস্য উৎপাদন, পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই অঞ্চলে স্থাপিত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহও ব্যাপক সুযোগ সুবিধা পাবে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের ২০০৩ সালের তিস্তা বিষয়ক রিপোর্ট অনুসারে ফ্ল্যাড প্লেইন এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ১৪ ভাগ কাভার করেছে তিস্তা নদী যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্নভাবে সরাসরি জীবিকার ব্যবস্থা করতে সক্ষম।
তিস্তা নদী প্রভাবিত অঞ্চলসমূহ; রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারি ও গাইবান্ধাকে বলা হয় দেশের অন্যতম শস্য ভাণ্ডার। নদী কর্তৃক সরবরাহকৃত সুবিধাসমূহ যেমনঃ কৃষি সেচ, মৎস্য উৎপাদন, পরিবহন সহজলভ্যতা ইত্যাদিসহ সেই এলাকার সার্বিক জীববৈচিত্রের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে একটি নদীর ভূমিকা অপরিসীম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তিস্তা নদীর অবস্থান বাংলাদেশের এই অঞ্চলটির জন্য অত্যন্ত আশীর্বাদ স্বরূপ। কিন্ত নদীটির বিপর্যস্ত অবস্থার দরূণ প্রতি বছরই বন্যা ও খরা দুই সময়েই নদীপাড়ের ও নদী প্রভাবিত স্থানসমূহের অধিবাসীরা অসহনীয় ভোগান্তির সম্মুখীন হোন। কেবল যথাযথ ব্যবস্থাপনায়ই পারে তিস্তা নদীকে উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলটির উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে।
লেখক: প্রভাষক (ভূগোল), রংপুর ক্যাডেট কলেজ, রংপুর ।
Email: sahidulislamges@gmail.com