মো. শহিদুল ইসলাম
শিক্ষার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, "শিক্ষা হল জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, বিশ্বাস এবং অভ্যাস অর্জনের প্রক্রিয়া" যা প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক বা যেকোন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংঘটিত হতে পারে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যাবতীয় ইতিবাচক গুণাবলী অর্জন করে পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য তৈরি হয়। এখন জানা দরকার সুন্দরভাবে বাঁচা মানে কী? আমি মনে করি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অর্থ হল, যে বেঁচে থাকা নিজ, পরিবার, সমাজ, দেশ সর্বোপরি সৃষ্টিকূলের সবার জন্য কল্যাণকর বা উপকারি হয়। কবির ভাষায় বলা যায়, "এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।" শিক্ষা একজন মানুষকে নিরহংকারী, সহিষ্ণু, পরোপকারী, আত্নবিশ্বাসী তথা পরিপূর্ণ ইতিবাচক মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। শিক্ষিত মানুষ কখনোই পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বা বোঝাস্বরূপ হয় না। যদি এমন না হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা বা পদ্ধতি যথার্থ নয়।
শিক্ষার উদ্দেশ্য টাকা-পয়সা, সম্পদ অর্জন কিংবা চাকরি করা নয় মোটেই। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন/ ছিলেন যারা শিক্ষা অর্জন না করেও অনেক অর্থ, সম্পদ অর্জন করেছেন/ করেছিলেন। একজন মানুষ শিক্ষা ছাড়াও প্রচুর অর্থ উপার্জন করে জীবন চালাতে পারেন। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে শিক্ষা অর্জন কেন দরকার? শুরুতেই বলা হয়েছে, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষা অর্জন করা দরকার বা শিক্ষিত হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বিপরীত কথাও আসতে পারে। অনেকেই বলতে পারেন; শিক্ষিত মানুষেরাও তো দূর্নীতি করেন, পরিবারে, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন, অন্যায় করেন ইত্যাদি, ইত্যাদি। এর উত্তরে বলা যায়, সেই ব্যক্তি/ ব্যক্তিবর্গের যথাযথ শিক্ষা অর্জিত হয়নি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একজন শিক্ষিত মানুষ কিংবা একটি শিক্ষিত সমাজ কখনোই অসুন্দর হতে পারে না, বাসযোগ্যহীন হতে পারে না।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমান সময়ে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গ্রাম হতে শহরে; প্রতিটি মানুষ এখন শিক্ষা অর্জন করে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের জন্য। প্রায় সব শিক্ষার্থীই শিক্ষা কিংবা উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে ভালো একটা চাকরি কিংবা উচ্চ বেতন পাবে এই আশায়। এই মুহূর্তে দেশের এমন কোনো শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না, যে চাকরির উদ্দেশ্য ছাড়াই শিক্ষা অর্জন করছে। শিক্ষা বিষয়টি বর্তমানে প্রচণ্ড রকম বাণিজ্যিক আকার ধারণ করেছে। শিক্ষা অর্জন বা পড়ালেখা শেষে যে ব্যক্তি/ ব্যক্তিরা চাকরি পায় না, সে/ তারা আসলে শিক্ষিতই হয়নি বর্তমান সমাজে এমনটিই বিবেচনা করা হয়। এই রোগ সমাজের একেবারে কম বোঝা মানুষটি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশের মত জনসংখ্যা বহুল দেশে শতভাগ তো দূরের কথা, আমি মনে করি ৫০ ভাগ শিক্ষিত মানুষকেও চাকরির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। এদেশে সরকারি, বেসরকারি সবমিলিয়ে চাকরির যে সংখ্যা সেটি একেবারেই কম। এটি সরকার বা চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের কোন দোষ নয়।
ধরা যাক, দেশের সব মানুষই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, সবাই উচ্চ নম্বরধারী। তখন কী হবে? সকলের জন্য কি চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে? প্রশ্ন হল তাহলে কি শিক্ষা অর্জন করব না? অবশ্যই শিক্ষা অর্জন করতে হবে। শিক্ষা ছাড়া কোন সমাজ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে শিক্ষা অর্জন করলেই যে চাকরি করতে হবে, অনেক অর্থ উপার্জন করতে হবে এমনটি হওয়া উচিত নয়। কোন ব্যক্তি যে কাজই করুক না কেন, শিক্ষা অর্জন সবার জন্যই দরকার, খুব দরকার। কিন্ত সমস্যা তখনই তৈরি হয়, যখন শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমরা চাকরি ব্যতীত অন্য কর্মমুখী হতে অপছন্দ করি। কেবল চাকরি ছাড়া অন্যসব কাজকে অবহেলা করি যা কাম্য নয় একেবারেই।
একটু লক্ষ্য করা যাক, দেশে মাস্টার্স পাশ করা ২৫-৩০ বছর বয়সী একজন ছেলে-মেয়েকে (খুবই অল্প সংখ্যক চাকরি ব্যতীত: বিসিএস, আর্মি অফিসার ও অন্যান্য প্রথম শ্রেণির চাকরি) ১০-১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদান করতে হয় অপরদিকে পড়ালেখা না জানা একজন দিনমজুর কিংবা শ্রমিকও দৈনিক হাজিরাবাবদ প্রায় ৪০০-৬০০ টাকা উপার্জন করেন মাস শেষে যা ১২-১৬ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। কোন ব্যক্তি কোন কারখানায়/ গার্মেন্টসে ২০ বছর কাজ করলে তার বেতনও লক্ষ টাকা হয় অন্যদিকে প্রায় ২০ বছর পড়ালেখা করে একজন যুবক/ যুবতী মাত্র ১০-২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদান করে। শিক্ষাই কেবল অর্থ উপার্জনের উপায় নয়। কাজেই আমাদেরকে কর্মমুখী হতে হবে, আমরা যে কাজই করি না কেন শিক্ষা অর্জন আমরা করবো স্ব স্ব অবস্থান তথা কর্মেই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য। মনে রাখতে হবে, পড়ালেখা শেষ করলেই রাষ্ট্র আপনাকে চাকরি দিতে বাধ্য নয়। পড়ালেখা বা শিক্ষা অর্জন করতে হবে কেবল নিজেকে সুন্দর করার জন্যই।
দেশের উন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নজর দিতে হবে। সকলে একই কাজ করলে অন্য কাজগুলো কে করবে? শতকরা ৮০ ভাগ কৃষি নির্ভরশীলতার দেশে সবার চাকরির ব্যবস্থা করা চাইলেও সম্ভব হবে না কখনোই। চাকরি করে শুধু নিজে বেঁচে থাকার চেয়ে এমন কিছু করার চেষ্টা করুন, যাতে সমাজ বা দেশের মানুষ আপনার কাছ থেকে কিছু পায়। বঙ্গবন্ধু যথার্থই বলেছেন, 'লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু থাকে বাপ-মাকে সাহায্য কর। প্যান্ট পরা শিখেছো বলে বাবার সাথে হাল ধরতে লজ্জা করো না। দুনিয়ার দিকে চেয়ে দেখ। কানাডায় দেখলাম ছাত্ররা ছুটির সময় লিফট চালায়। ছুটির সময় দু'পয়সা উপার্জন করতে চায়। আর আমাদের ছেলেরা বড় আরামে খান, আর তাস নিয়ে ফটাফট খেলতে বসে পড়েন।' বঙ্গবন্ধুর আরো একটি বক্তব্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, 'গ্রামে গ্রামে বাড়ীর পাশে বেগুন গাছ লাগিও, কয়টা মরিচ গাছ লাগিও, কয়টা লাউ গাছ ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগিও। বাপ-মারে একটু সাহায্য কর। কয়টা মুরগী পাল, কয়টা হাঁস পাল। জাতীয় সম্পদ বাড়বে। তোমার খরচ তুমি বহন করতে পারবে। বাবার কাছ থেকে যদি এতোটুকু জমি নিয়ে ১০ টি লাউ গাছ, ৫০ টা মরিচ গাছ, কয়টা নারিকেলের চারা লাগায়ে দেও, দেখবে ২/৩ শত টাকা আয় হয়ে গেছে। তোমরা ঐ টাকা দিয়ে বই কিনতে পারবে। কাজ কর, কঠোর পরিশ্রম কর, না হলে বাঁচতে পারবে না।" বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো সত্যিই অসাধারণ ও বাস্তবমুখী!
একজন সাধারন খেটে খাওয়া মানুষও এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তার সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। খুব সাধারণভাবে হলেও মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয় এবং শিক্ষার অর্জনের এই দীর্ঘ সময়ে একজন শিক্ষার্থী তার পরিবারে কোন ধরণের অর্থনৈতিক অবদান রাখতে পারে না। পড়ালেখা শেষে তার চাকরি পেতে হয়তো আরো তিন/চার বছর চলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো চাকরি পাওয়া সম্ভবই হয় না। তখন এই শিক্ষার্থীর পেছনে গরীব পিতার করা বিনিয়োগ পুরোটাই বৃথা হয়ে পড়ে। আসলে সমাজের প্রতিটি স্তরে চিন্তাধারার পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষা অর্জনের দীর্ঘযাত্রায় একজন শিক্ষার্থীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ারও যাবতীয় শিক্ষা প্রদান করতে হবে। শিক্ষা যেন আমাদের জীবনকে কেবল চাকরি নামক নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ করে না ফেলে সেদিকে গভীর দৃষ্টিপাত প্রয়োজন। এক্ষেত্রেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাগুলো চিরস্মরণীয়, "শুধু বিএ, এমএ পাস করে লাভ নেই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, কলেজ ও স্কুল, যাতে সত্যিকারের মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে। কেরানী পয়দা করেই একবার ইংরেজ শেষ করে দিয়ে গেছে দেশটা। তোমাদের মানুষ হতে হবে ভাইরা আমার। আমি কিন্তু সোজা সোজা কথা কই, রাগ করতে পারবে না। রাগ কর, আর যা কর, আমার কথাগুলো শোন।" অভিভাবক, শিক্ষকসহ সকলকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে যাতে আমাদের ছেলে-মেয়ে, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষে অকর্মণ্য হয়ে না পড়ে, কোন কাজকে ছোটভাবে না দেখে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাও জরুরি, তা না হলে আমাদের যুব সমাজ/ তরুণরা খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। আমাদের ইতিবাচক মনোভাব ও সহযোগিতাই পারে যুবক/তরুণ সমাজকে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও নানা ধরণের কর্মে নিযুক্ত করতে।
আমার একজন প্রিয় শিক্ষক প্রায়ই বলতেন, তুমি পেঁয়াজের দোকানদার হও। ৫০০ টাকা পুঁজির বাদাম বিক্রেতা হও। কোন সমস্যা নেই। ভালভাবে বাঁচতে চাইলে তোমাকে মাস্টার্স পাশ করেই তা হতে হবে। আসলে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া নয়। অর্থ উপার্জনের সাথে শিক্ষার কোনো সম্পর্কই থাকা উচিত নয়। যখন সমাজে এখনকার মত শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল না, তখনও কিন্ত মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে ছিল। মোদ্দা কথা হল, একজন মানুষ শিক্ষিত হয়ে যাই করুক না কেন, সে শিক্ষিত, সে সুন্দর, সে সুখী।
শিক্ষিত মানেই চাকরিজীবী, অনেক উচ্চ বেতনধারী, অনেক প্রভাবশালী এই ধারণাগুলো পাল্টাতে হবে। প্রতিটি পেশাকে সম্মান করতে শিখতে হবে। একটি স্লোগান মাথায় রাখতে হবে, আমরা সবাই শিক্ষিত কিন্তু কর্মের ধরণ ভিন্ন ভিন্ন। পরিশেষে বলতে চাই, চাকরির জন্য শিক্ষা অবশ্যই জরুরি, তবে শিক্ষা যেন কেবল চাকরির জন্য না হয়। শিক্ষা ব্যক্তিক উন্নয়নে সহায়ক মাত্র। প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ যেকোন ইতিবাচক কর্মের মাধ্যমে নিজ, পরিবার, সমাজ সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠবে এটিই সর্বদা প্রত্যাশিত।
লেখক: প্রভাষক (ভূগোল), রংপুর ক্যাডেট কলেজ, রংপুর ।
Email: sahidulislamges@gmail.com