আর্কাইভ  সোমবার ● ২১ এপ্রিল ২০২৫ ● ৮ বৈশাখ ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২১ এপ্রিল ২০২৫

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও আমাদের অর্জন

বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, দুপুর ০১:২৪

Advertisement

শেখ মাজেদুল হক

সারা পৃথিবীতে আজ বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি আমাদের এই স্বাধীনতার যাত্রায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন তার শতবর্ষী জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা, এটি সত্যিই আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্য এবং মাইলফলক। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা, সকল শহীদ এবং আমাদের জনগণ যারা বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন এবং সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন তাদের আত্মত্যাগর ঋণ কখনই শোধ হবে না। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা । আজকের এই দিনে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে পারা জাতির প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য বিশেষ অনুভূতি ও গৌরবের। এখন ৫০ বছর বয়সে আমরা একটি দেশ হিসাবে আমাদের সমস্ত কৃতিত্ব উদযাপন করার অধিকার অর্জন করেছি এবং আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলিকে  আটকে রেখেছি। আর্থ-সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক দিয়ে আমরা এমনকি আমাদের কঠোর সমালোচকদেরও বিস্মিত করেছি।

আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চমকপ্রদ এবং ধারাবাহিক হয়েছে - একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যা আমাদের সাহায্য করছে। রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা ছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। এর মধ্যে রয়েছে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চলক এবং কীভাবে এই গতি আরও বজায় রাখা যায় তার জন্য বর্তমান সরকার খুবই আন্তরিক, স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বৃদ্ধি, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে জাতি গঠনে আমাদের স্থানীয় এনজিওগুলোর ভূমিকা, বেসরকারি খাতের অবদান ও প্রবৃদ্ধি, তৈরি পোশাক শিল্প, আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের অবদান, অন্যান্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদান, আমাদের সামুদ্রিক বিজয়, বিদেশে আমাদের শান্তিরক্ষীদের অর্জিত খ্যাতি, কৃষিতে আমাদের অগ্রগতি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, আমাদের অবকাঠামো মেগা প্রকল্পগুলি আমাদের উন্নয়নকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে এবং সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে আমাদের যাত্রা যথাযথ ভাবে অব্যাহত আছে এবং আগামীতেও থাকবে।স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিনির্ভর থেকে বেরিয়ে শিল্পনির্ভর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১১ টি দেশের একটি বাংলাদেশ। দেশে কোন খাদ্য সংকট নেই। এই মহামারীতেও আমরা আমাদের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে রাখতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর। সারাদেশে ৩৯ টি হাই-টেক পার্ক সফটওয়্যার টেকনোলজি স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল খাতে রপ্তানি এখন ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে ২০১৮ সালে ।আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলারের রেকর্ড ছোঁয়ার প্রহর গুনছে। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

 স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের কারণে বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গেল বছর । বৈশ্বিক নেতারা – যেমন জো বাইডেন থেকে শি জিনপিং, বরিস জনসন থেকে ভ্লাদিমির পুতিন, জাস্টিন ট্রুডো থেকে ইয়োশিহিদে সুগা, পোপ ফ্রান্সিস থেকে আন্তোনিও গুতেরেস - অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন, এবং আমাদের অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ পাঁচজন দক্ষিণ এশীয় নেতা ১৭-২৬ মার্চ পর্যন্ত মেগা ইভেন্টে যোগ দিয়েছিলেন, যুগল উদযাপনকে আঞ্চলিক নেতাদের একটি ইউনিয়নে পরিণত করেছেন যারা সংযোগ, বাণিজ্য এবং পর্যটন বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের একীকরণের প্রতিশ্রুতি পুনর্নবীকরণ করেছেন। মহাদেশ জুড়ে বাংলাদেশ মিশনগুলি এই অনুষ্ঠানটি উদযাপন করেছে এবং মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, কর্মকর্তা এবং শিক্ষাবিদরা এতে যোগ দিয়েছেন। ২৬শে মার্চ, দ্য লন্ডন আই, ইউরোপের সবচেয়ে লম্বা ক্যান্টিলিভারড পর্যবেক্ষণ চাকা, বাংলাদেশের পতাকার রং সবুজ ও লাল হয়ে গেছে। আমাদের উদযাপনে বিশ্বব্যাপী নেতারা যোগদানের ফলে বৈশ্বিক মঞ্চে আমাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। উদযাপনটি বাংলাদেশের সাফল্য প্রদর্শনের একটি সুযোগ ছিল, যাকে একসময় হেনরি কিসিঞ্জার "তলাবিহীন ঝুড়ি" এবং ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং ক্ষুধার সমার্থক হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। এখন, দেশটি একটি এশিয়ান টাইগার যা বছরের পর বছর ধরে টেকসই বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, আয়ু বৃদ্ধি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়ন দেখেছে। দেশটি ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং বাণিজ্য অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিভিন্ন দেশের সাথে অগ্রাধিকারমূলক বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে প্ররোচিত করেছে। এটি জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ, যার একটি বড় অংশ তরুণ এবং প্রযুক্তি জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত। ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশসহ প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে বসবাস করে। চীনের পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। “মেইড ইন বাংলাদেশ” এখন এক গর্বের নাম। অন্যান্য খাত যেমন ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া, জাহাজ শিল্প, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, এবং আইটি ইত্যাদি তার অবস্থান ধরে রেখেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং সংযোগ বিকাশের মাধ্যমে দেশটি ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের জন্য একটি লাভজনক গন্তব্য হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক ফোরামেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। দেশটি অভিবাসন সংক্রান্ত গ্লোবাল কমপ্যাক্টের পিছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে শান্তিরক্ষী পাঠানোর বৃহত্তম দেশ।

পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অবস্থান শূন্যের অঙ্কের খেলা নয়। এটি চীন-নেতৃত্বাধীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ যোগ দিয়েছে এবং এর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকেও সমর্থন করে। ঢাকা তার পররাষ্ট্র নীতি বজায় ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে "সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়'" । জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা , ডিজিটালাইজেশন, পারস্পারিক বাণিজ্য ও উন্নয়নে বেশি আন্তরিক ও আগ্রহী। 

১৯৭১সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। এই অর্জনকে অর্থবহ করতে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে ও জানাতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দিতে হবে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

মন্তব্য করুন


Link copied