শেখ মাজেদুল হক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৯ সালের এই দিনে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন ড. শামসুজ্জোহা। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়েছিল পাক-হানাদার বাহিনী হটাও আন্দোলন। সেদিন নিজের জীবনের বিনিময়ে বাঁচিয়ে ছিলেন হাজারো শিক্ষার্থীর জীবন। তিনিই পাক-হানাদারদের হাতে নিহত প্রথম বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী।
১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ড. শামসুজ্জোহা। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৪৮ সালে বাকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১ম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে ক্রিশ্চান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৪ সালে স্নাকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে অর্ডিন্যান্স কারখানায় শিক্ষানবিশ সহকারী কারখানা পরিচালক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগ দেন। শহীদ হওয়ার সময় তিনি স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান। দীর্ঘদিন ধরে তারা আমেরিকা বসবাস করছেন। এখন তারা সেখানকার নাগরিক হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।
“আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে”। ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর আইয়ুব খান সরকার হামলা চালালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সন্ধ্যায় সবার সামনে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত নিজের শার্ট দেখিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এসব কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর শহীদ ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টমেন্টে বন্দি অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করার প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। একই সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় জেলা প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করে। ওইদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মুক্তিকামী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা বের করেন। শোভাযাত্রাটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ মুক্তিকামী জনতার সংঘর্ষ বাধে।সংঘর্ষে অনেকে আহত হন, অনেকেই হন কারাবন্দি। ওই ঘটনা শোনামাত্র ড. শামসুজ্জোহা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং আহত মুক্তিকামী জনতাকে নিয়ে হাসপাতালে যান। এ ঘটনার পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে চরম উত্তেজনা।
বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নেন। অপরদিকে সশস্ত্র বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে প্রস্তুত রাখাসহ মেইন গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়, যেন ছাত্র-জনতা বের হতে না পারেন।এরপর আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সব প্রতিরোধ ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মেইন গেটের সীমানা প্রাচীর টপকে বের হওয়া শুরু করলে শিক্ষকরা মেইন গেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীকে গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন।এহেন সংকটময় মুহূর্তে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার দোসররা রাইফেল উঁচিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকলে ছাত্ররা পাকবাহিনীর পার্ক করা একটি গাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ড. জোহা পাকসেনা অফিসার ক্যাপ্টেন হাদির সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান এবং তাকে অনুরোধ করেন যেন সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো উসকানিমূলক পদক্ষেপ না নেয়া হয়।
আস্তে আস্তে মেইন গেট সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ছাত্র-জনতার ঢল নামতে শুরু করলে সেনাবাহিনীর লোকজন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করতে প্রস্তুত হয়। এমতাবস্থায় ড. জোহা হাত উঁচু করে পাকসেনাদের উদ্দেশে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, “প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার; আমার ছাত্ররা এখান থেকে এখনই চলে যাবে…....।” কিন্তু পাক হায়েনারা সেদিন ড. জোহার সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। কিছুক্ষণ পরই অতি নিকট থেকে তাদের রাইফেলের ছোড়া গুলি জোহার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠের দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
আহত ড. জোহাকে সেনাবাহিনীর ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় মিউনিসিপ্যাল অফিসে। সেখানে তাকে চিকিৎসা না দিয়ে দীর্ঘসময় অবহেলায় ফেলে রাখা হয়। পরে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল ৪টার দিকে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই এই মহান শিক্ষক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পরে মহান এই শিক্ষককে সমাহিত করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে। যা এখন জোহা চত্ত্বর নামে পরিচিত। এছাড়া শহীদ ড. জোহাকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি হলের নামকরণ করা হয় শহীদ শামসুজ্জোহা হল।
ড. জোহার রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। পতন ঘটেছিল সামারিক জান্তা আইয়ুব খানের। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভীতও রচিত হয়েছিল ড. জোহার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ড. জোহাকে।ড. জোহার মৃত্যুর ঘটনা সে সময় দেশের চলমান আন্দোলনকে এনে দেয় দুর্বার গতি। তৎকালীন সরকার উপায়ান্তর না দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
এরপর থেকে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনটিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে ড. জোহার শাহাদতের দিনটিকে দীর্ঘদিন ধরে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দিবসটি শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হয় ‘জোহা দিবস’ হিসেবে।শহীদ ড. জোহার আত্মত্যাগের অর্ধশত বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখন পর্যন্ত এ দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। জাতি হিসেবে আমাদের সবারই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দিবসটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ; বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।