মো. শহিদুল ইসলাম
কোভিড-১৯ দ্বারা বিশ্বব্যাপী ক্ষতিগ্রস্ত খাতসমূহের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। বিশেষ করে বাংলাদেশের সর্বস্তরের শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রযুক্তিগত সমস্যাসহ নানাকারণেই আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে পারিনি। দীর্ঘ দুই বছর ধরে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরাও বাড়িতে অবস্থানের কারণে রুটিন মাফিক পড়ালেখা করছে না। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থীরাই অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
কোভিড কবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে সেটাও অনিশ্চিত। গত দুই বছরে কোভিড পরিস্থিতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। চলমান কোভিড পরিস্থিতি ভবিষ্যতে কোনদিকে মোড় নেবে তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে কার্যক্রম ব্যাহত হলেও শিক্ষার্থীদের বসে থাকলে চলবে না। একথাও সত্য যে শিক্ষার্থীদের একা একা পড়ালেখা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া কষ্টকর। শুধু পড়ালেখাই নয় দীর্ঘদিন বাড়িতে অবস্থানের ফলে শিক্ষার্থীদের নানারকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে/ হয়ে পড়েছে।
এই সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য অতিদ্রূতই কাজ শুরু করতে হবে তা না হলে একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মধ্যে পড়বে। আমাদের শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যাতে এই দূর্যোগে মুহূর্তেও আর তেমন প্রভাবিত না হয়; সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এমতাবস্থায় বাসায় অবস্থানকালে নিদির্ষ্ট কিছু বিষয় অনুসরণ করলে কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে বলে মনে করি। আমার মতে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করলে আশা করা যায় একজন শিক্ষার্থী শারীরিক, মানসিকভাবে উপযুক্ত থাকাসহ পড়ালেখার ক্ষেত্রেও উপকৃত হবে।
১. সঠিক খাদ্যাভ্যাস চর্চা :
করণীয় :
# পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা।
# সময়মত খাবার গ্রহণ করা।
# ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণ ও নিয়মিত খাওয়া।
# ভালভাবে রান্না করা (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও যথাযথভাবে সিদ্ধ করা) খাবার খাওয়া।
# ভিটামিন সি জাতীয় যেকোন খাবার প্রতিদিন খাওয়া।
# খাবার গ্রহণের আগে ও পরে ভালভাবে হাত ধোয়া।
# পরিষ্কার স্থান ও পাত্রে খাবার খাওয়া।
অকরণীয়:
# তেলে ভাজা ও চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা।
# কাঁচা বা আধা সিদ্ধ খাবার না খাওয়া (কাঁচা ফলমূল ব্যতীত)।
# জাঙ্ক ফুড না খাওয়া।
# একেবারে বেশি করে খাবার না খাওয়া।
# অপরিষ্কার স্থান বা প্লেটে বা বাসনে খাবার না খাওয়া।
# ঠান্ডা ও বাসি খাবার পরিহার করা।
# পানি পানে দীর্ঘ বিরতি না দেওয়া।
# দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে না থাকা (রোজা বা উপবাস ব্যতীত)।
২. শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি:
করণীয়:
# পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ (উত্তম ব্যায়াম) সঠিক ভাবে আদায় করা বা নিজ নিজ ধর্ম ধর্ম চর্চা করা।
# পুশ আপ, ইয়োগা ও ট্রেডমিলে দৌড় ইত্যাদি শারীরিক অনুশীলন নিয়মিত করা।
# নিয়মিত ঘর মোছা ও বিছানাপত্র গোছানো।
# মাকে রান্নায় ও খাবার পরিবেশনের সাহায্য করা।
# নিজের কাপড়চোপড় নিজে ধুয়ে দেওয়া।
# নিজে রান্না করার চেষ্টা করা।
# তাড়াতাড়ি ঘুমানো ও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা।
অকরণীয়:
# বেশিক্ষণ না ঘুমানো।
# বেশিক্ষণ শুয়ে না থাকা
# বেশিক্ষণ বসে না থাকা।
# দুশ্চিন্তা না করা।
# দীর্ঘসময় একা একা না থাকা।
# নিজ কক্ষের দরজা অপ্রয়োজনে বন্ধ করে না রাখা।
# বেশি রাত করে না ঘুমানো।
৩. পড়াশোনা (সিলেবাসভুক্ত ও অন্যান্য):
করণীয়:
# যথাসময়ে সিলেবাস শেষ করা ও রিভিশন দেয়ার চেষ্টা করা।
# পাঠ্য বইয়ের নোট তৈরি করা এবং এক্ষেত্রে হাতের লেখা সুন্দর, পরিষ্কার, ও দ্রুততায় গুরুত্ব দেয়া।
# বেশি বেশি পরীক্ষা বা মক টেস্ট দেয়া।
# বিজ্ঞানমূলক গল্পের বই বেশি বেশি পড়া। (এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সাহায্য নেয়া যেতে পারে)
# প্রতিদিন গণিত চর্চা করা।
# প্রতিদিন নিয়ম অনুসারে পড়ালেখা করা।
# সম্ভব হলে প্রতিদিন ছোট ভাই-বোনকে পড়ানো।
# পাঠ্য বইগুলো যত সম্ভব হাতের নাগালে ও সবসময় চোখে পড়ে এমন স্থানে ভালভাবে গুছিয়ে রাখা।
# বিষয়ে শিক্ষকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।
অকরণীয়:
# কম আলোতে না পড়া।
# সময় নষ্ট না করা।
# একটানা দীর্ঘক্ষণ পড়ালেখা না করা।
# পাঠ্যবই লকারে বা অন্য কোথাও আবদ্ধ করে না রাখা বা চোখের আড়ালে না রাখা।
# পাঠ্যবই এলোমেলো/ অগোছালোভাবে না রাখা।
৪. সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং দক্ষতা বৃদ্ধি:
# আয়নার সামনে নিজের চোখে চোখ রেখে বক্তৃতা করা, বিতর্ক করা, পাবলিক স্পিকিং করা, মতামত প্রদান করা, পরামর্শ দেয়া ইত্যাদি।
# গল্প, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস (সম্ভব হলে) লেখার চেষ্টা করা।
# প্রাকৃতিক ছবি বেশি বেশি আঁকা।
# সৃজনশীল কাজ যেমনঃ রান্নার কৌশল আয়ত্ত করা, প্রোগ্রামিং শেখা, বিজনেস আইডিয়া নোট করা, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে চর্চা ও গবেষণা করা, ক্রাফটিং শেখা ইত্যাদি।
# নিয়মিত মেডিটেশন করা।
# নিজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করার চেষ্টা করা।
# নিজেকে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
# আত্ম সমালোচনা করা ও নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা।
# বাবা-মাকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা।
# ছোট ভাই বোনদের আদর-স্নেহ করা ও তাদের পড়ালেখায় সাহায্য করা।
# বড়দের শ্রদ্ধা ও তাদের কাজে সহযোগিতা করা।
# পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্ব সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচকভাবে চর্চা করা।
৫. অভিভাবকদের জন্য করণীয়:
# সন্তানদের সাথে নিয়মিত গল্প করা।
# সন্তানদের নিয়ে একসাথে খাবার খাওয়া।
# সন্তানরা যাতে দীর্ঘক্ষণ একা নিজকক্ষে দরজা বন্ধ করে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা।
# সন্তানদের গালিগালাজ না করা।
# সন্তানদের সৃজনশীল কাজে উৎসাহ প্রদান করা।
# সন্তানরা যাতে মনমরা বা হতাশ না হয় পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা।
# সন্তানদের নিয়মিত খাওয়া, ঘুম, গোসল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা।
# সন্তানদের মানসিক চাপ না দেয়া।
# সন্তানদের হিংসা, লোভ, মিথ্যা বলা, পরশ্রীকাতরতা থেকে মুক্ত রাখা।
# সন্তানদের সৎ,পরিশ্রমী, উদ্যমী, উদার মানসিকতা তৈরিতে সাহায্য করা।
# নিজেদের বদ অভ্যাস যেমনঃ ধূমপান পরিহার করা, তামাক না খাওয়া ইত্যাদি।
# অভিভাবকরা চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ঘরের বাইরে যত সম্ভব কম যাওয়া।
# সন্তানদেরকে তাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে ফোনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ করানো।
# সন্তানদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো চিহ্নিত করা।
# সন্তানদের নিয়মিত মানসিক প্রেষণা প্রদান করা।
# সন্তানদের নেতিবাচক দিকগুলোকে যত সম্ভব সঠিক পদ্ধতিতে শোধরানোর চেষ্টা করা।
# সন্তানদের ইতিবাচক দিকগুলোর প্রশংসা করা।
# সামাজিক ও পারিবারিক কলহ-বিবাদ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখা।
# সন্তানদের সামনে প্রফুল্লতা এবং হাসি-খুশি ভাব বজায় রাখা।
৬. শিক্ষকদের জন্য করণীয়:
# শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা ও প্রেষণা প্রদান করা।
কোভিড বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের জীবনে অসহনীয় ও মারাত্নক প্রভাব ফেলেছে। শীরিরিক ও মানসিকভাবে মানুষ হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। তবে করোনার এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করে কিংবা পরিবেশ, পরিস্থিতির সাপেক্ষে ঐসব বিষয়ের সাথে অন্যান্য কিছু বিষয় সংযোজন বা বিয়োজন করলে প্রত্যাশা করা যায় আমাদের শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবে।
লেখক: প্রভাষক (ভূগোল), রংপুর ক্যাডেট কলেজ, রংপুর।
ইমেইলঃ sahidulislamges@gmail.com