আর্কাইভ  রবিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৫ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩২
আর্কাইভ   রবিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৫

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠা সাল পরিবর্তন ও কিছু প্রশ্ন

শনিবার, ২১ মে ২০২২, রাত ১০:৩৫

Advertisement

শাহ্‌ রিয়াদ আনোয়ার শুভ 

সম্প্রতি রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির নতুন সাইন বোর্ডে প্রতিষ্ঠার সাল ১৮৫৪ থেকে ২২ বছর এগিয়ে এনে  ১৮৩২ করা হয়েছে। ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠা মানে এটাই অবিভক্ত বাংলার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরী। কেননা কোলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা ১৮৩৬ সালে। অনেক গর্বের বিষয় আমাদের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন এসে যায়, এতদিন এটার সাল ১৮৫৪ কেন বলা হচ্ছিল? সর্বশেষ জেলা গেজেটিয়ারেও কেন ১৮৫৪ বলা হচ্ছে? অবিভক্ত বাংলা এবং বাংলাদেশের লাইব্রেরির ইতিহাসে কেন ১৮৫৪ সাল বলা হচ্ছে? আমার মনে এমন আরও কিছু প্রশ্ন এসেছে, যা সবার সাথে শেয়ার করছি। 

প্রথমেই বলে রাখি, রংপুরের পাবলিক লাইব্রেরি ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন তথ্য আমি পেয়েছি শুধুমাত্র ১৯১১ সালে প্রকাশিত ইস্টার্ন বেঙ্গল এ্যান্ড আসাম ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারে (Eastern Bengal And Assam District Gazetteers Rangpur - J.A Vas 1911)। এছাড়াও পাওয়া যায় জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার সম্পাদিত ❛বংশ পরিচয়❜ তৃতীয় খণ্ডে। দুই সূত্রের মধ্যে আবার মিল নেই। জেএ ভাস বলছেন, ❛১৮৩২ সালে কুণ্ডির জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠিত একটি পাবলিক লাইব্রেরি ছিল❜। জ্ঞানেন্দ্র কুমার বলছেন, ❛১৮৩৬ সালে রংপুর নগরে উচ্চ বিদ্যালয়, সদর হাসপাতাল এবং সাধারণ পুস্তকাগার কুণ্ডির জমিদার রাজমোহন রায় চৌধুরীর অর্থ সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল❜। জেএ ভাসের এক লাইনের মন্তব্যে কি প্রমাণিত হয় যে, কুণ্ডির জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত পাবলিক লাইব্রেরি-ই রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি? আবার জ্ঞানেন্দ্র কুমারের ভাষ্য তো বোঝা মুশকিল! তিনি জিলা স্কুলের প্রতিষ্ঠার সাল ১৮৩৬ বলেছেন, যা সঠিক নয়। কুণ্ডির জমিদার রাজমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা সাল তিনি উল্লেখ করেননি।  
 
এই দুই সূত্র ছাড়া এই বিষয়টাকে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ করছেন, ডঃ মণিরুজামান তাঁর ❛রংপুরের ইতিহাস❜ বইয়ে। তিনিও ১৯১১ সালের গেজেটিয়ার ও বংশ পরিচয়কেই রেফারেন্স দিয়েছেন। তবে তাঁর বইয়ে তিনি এডিশনাল কিছু তথ্য যুক্ত করেছেন, যদিও সেই তথ্য তিনি কোথায় পেয়েছেন তা উল্লেখ করেননি। এই অতিরিক্ত যে তথ্য তিনি যোগ করেছেন তাতেই তিনি জোর দিয়েছেন রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেছেন, ❛১৮৩২ সালে কুণ্ডিতে প্রতিষ্ঠিত পাবলিক লাইব্রেরিই অবিভক্ত বাংলার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি বললে অত্যুক্তি হবে না❜। ওনার বক্তব্যের মধ্যে ফাঁক পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে। যে কথা জেএ ভাস বা জ্ঞানেন্দ্র কুমার বলেননি, সেই কথা উনি লিখে রেফারেন্স দিচ্ছেন তাঁদের। আমি রেফারেন্স চেক করে দেখেছি। শুধুমাত্র এই লাইনের উপরে ভিত্তি করে কি এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে, কুণ্ডির সেই লাইব্রেরিটাই বর্তমান পাবলিক লাইব্রেরী? কাছাকাছি সময়ে কাকিনাতেও একটা পাবলিক লাইব্রেরী ছিল, যা উল্লেখ করেছেন ডাবলু ডাবলু হান্টার। ( STATISTICAL ACCOUNT OF BENGAL : RANGPUR, W.W Hunter P-310) 

রংপুর অবিভক্ত বাংলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জেলা ছিল, যার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক কিছুরই সূচনা হয়েছে রংপুর থেকে। আর সেই সবের স্বীকৃতিও যথেষ্ট পাওয়া যায়। যেমন - রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ, বাংলার প্রথম সামাজিক নাটক কুলীনকুল সর্বস্ব, মুসলমানদের মধ্যে কোরআন শরীফের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, কোলকাতার বাহিরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম শাখা রংপুর সাহিত্য পরিষদ, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়, অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের প্রফুল্ল চক্রবর্তী। এইসব বিষয় বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের দ্বারাও স্বীকৃত। আর এ সবের স্বীকৃতি তো আমাদের পূর্বসূরিরাই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাহলে কোলকাতার পূর্বে যদি রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী হয়েই থাকে, তাহলে সেটা কেন আমাদের পূর্বসূরীরা বলেননি? বিগত প্রায় দেড়শত বছরে রংপুরের কোন লেখক, বুদ্ধিজীবী এমন দাবী করেননি যে, রংপুরের পাবলিক লাইব্রেরী অবিভক্ত বাংলার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরী। 

 ১৯১১ সালে জেএ ভাসের গেজেটিয়ার প্রকাশিত হবার পরেই রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী বিল্ডিং হয়েছে। যারা পাবলিক লাইব্রেরী ভবনে প্রতিষ্ঠা সাল ১৮৫৪ লিখলেন, তারা কেন লিখলেন? তারা কি ১৯১১ সালে জেএ ভাসের গেজেটিয়ার সম্পর্কে জানতেন না? আবার সর্বশেষ (আমার জানা মতে, ১৯৭৭ সালে ইংরেজিতে এবং ১৯৯০ সালে বাংলায়) জেলা গেজেটিয়ারে কেন ১৮৫৪ লেখা হলো? আমরা তো জানি, তথ্য হালনাগাদ হয়। যে কোন বইয়ের প্রথম মুদ্রণের ভুলত্রুটি পরের মুদ্রণে শুধরে নেওয়া হয়। এই বিবেচনায় কি সর্বশেষ জেলা গেজেটিয়ারটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিৎ নয়?  

আবার ১৮৪০ সালে কুণ্ডির রাজমোহন রায় চৌধুরীর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রংপুর ডিসপেনসারিতে (সদর হসপিটাল) ফলক লাগানো হয়েছে। অথচ, তার ৮ বছর আগে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী তিনি প্রতিষ্ঠা করলে এই তথ্যের কোন স্বীকৃতি নেই কেন? একই সাথে একই বছরে যদি স্কুল ও পাঠাগার হয় তাহলে তো তার স্বীকৃতি থাকা উচিৎ। আবার এটাও মাথায় রাখা উচিৎ, পুরো রংপুর মিলে তখন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কত ছিল? কত জন কুণ্ডিতে গিয়ে পাবলিক লাইব্রেরীতে পড়তে পারতেন? এমন কি হতে পারে না, কুণ্ডির লাইব্রেরিটি তাঁদের পারিবারিক লাইব্রেরী? যেমন কাকিনায় শম্ভু চরণ প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরী। এছাড়াও সেই সময়ে অনেক জমিদারদেরই ব্যক্তিগত পুস্তকালয় ছিল।   

রংপুর সাহিত্য পরিষদের সর্বেসর্বাদের একজন ছিলেন সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরী। বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধের রংপুরের সবচেয়ে অগ্রসর ব্যক্তিদের একজন। তিনিও কুণ্ডির জমিদার এবং রাজমোহন রায় চৌধুরীর পুত্র মধুসূদন রায় চৌধুরীর সন্তান (অর্থাৎ রাজমোহন চৌধুরীর আপন নাতি)। নিজ পূর্বপুরুষের (দাদা, Grandfather) কীর্তির কথা তো তারই ভাল জানার কথা। সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার প্রথম খণ্ডে (রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, প্রথম খণ্ড, ৫ম মাসিক অধিবেশন, পৃঃ ৫৮) রাজমোহন রায় চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে জিলা স্কুল, বার্তাবহ, ডিসপেনসারি (সদর হসপিটাল) প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৮৩২ সালে রাজমোহন রায় চৌধুরী পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করলে, সেটা উল্লেখ করলেন না কেন? 

১৮৫০ সালের ১৬ জুলাই ❛দেশহিতৈষী❜ পত্রিকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে রংপুরের কুণ্ডির তিন জন জমিদারের অবদান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রঙ্গপুর স্কুল, রঙ্গপুর চিকিৎসালয়, রঙ্গপুর বার্তাবহ এবং ভূম্যধিকারী সভার কথা বলা হয়েছে। ১৮৫০ সালের আগে যদি পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে তাহলে এখানে তো পাবলিক লাইব্রেরীর প্রসঙ্গও থাকার কথা। কারণ, সেই সময়ে রংপুরের মতো শহরে পাবলিক লাইব্রেরী অনেক বড় একটা বিষয়। কিন্তু সেটার উল্লেখ নেই কেন? (সূত্র : রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ - ডঃ রতন লাল চক্রবর্তী ও সুশান্ত চন্দ্র খাঁ সম্পাদিত, পৃঃ ৫২)।  সবচেয়ে বড় কথা ১৮৫৪ সালটা আসলই বা কেন এবং কিভাবে, যদি প্রতিষ্ঠা ১৮৩২ সালে হয়? আসলে ১৮৫৪ সাল আসাটা খুবই যৌক্তিক। কারণ, বাংলাদেশের গণগ্রন্থাগারের ইতিহাসে এই সালটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সাল। 

এবারে আসি অবিভক্ত বাংলায় পাবলিক লাইব্রেরি প্রসঙ্গে। ১৮৩৫ সালের ২০শে আগস্ট কলিকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত সাধারণ সভায় স্থির হয় যে কলিকাতার কেন্দ্রস্থলে মেটকাফের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্থায়ী  নিদর্শন স্বরূপ ‘‘মেটকাফে লাইব্রেরী বিল্ডিং’’ নামে একটি ভবন নির্মিত হবে এবং এখানে সাধারণের জন্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হবে। এটাই মূলত পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয় কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতে।  গ্রন্থাগারের কাজ শুরু হলেও প্রকাশ্যভাবে উন্মোচিত হয় ১৮৩৬ সালের ৮ই মার্চ। এটাই ছিলো অবিভক্ত বাংলার সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত প্রথম গণগ্রন্থাগার। (বঙ্গ সংস্কৃতির কথা : যোগেশ চন্দ্র বাগল পৃঃ ২) 

১৮৫০ সালে ইংল্যান্ডে গণগ্রন্থাগার আইন পাশ হওয়ার পর এরই সূত্র ধরে এ উপমহাদেশে বেসরকারি গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৫৪ সালে ৪ টি বেসরকারি গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারগুলো হলো - উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি, বগুড়া, যশোর পাবলিক লাইব্রেরি, বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি। এই তথ্যের সমর্থনে অসংখ্য ডকুমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে রংপুরের সুফী মোতাহার হোসেন, মুহাম্মদ আলীম উদ্দিন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসন প্রকাশিত রংপুর জেলার ইতিহাস, জেলা গেজেটিয়ারসহ বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন লেখকের বইয়ে। এছাড়াও কিছু থিসিস পেপারে, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বিভিন্ন সাময়িকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায়। খোদ গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর তাদের ওয়েব সাইটে বাংলাদেশে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছে, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৫৪ সালে। 

যখন আমরা ১৮৩২ সালে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত বলতে যাবো, যখন অবিভক্ত বাংলার প্রথম লাইব্রেরি রংপুরে বলতে যাবো এবং এর স্বীকৃতি আদায় করতে যাবো, তখন অন্যদের (দেশী বা ভারতের) জবাব দেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য কি আমাদের কাছে আছে? যেখানে ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এর সমর্থনে সরকারি বেসরকারি, বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন লেখকের বইয়ে পাওয়া যাচ্ছে। 

রংপুরের একজন নাগরিক হিসাবে আমি মনে করি, শুধুমাত্র শুধুমাত্র ১৯১১ সালে প্রকাশিত "ইস্টার্ন বেঙ্গল এ্যান্ড আসাম ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার - রংপুর" এ থাকা একটি মাত্র লাইন (১৮৩২ সালে কুণ্ডিতে একটি পাবলিক লাইব্রেরী ছিল) থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা কোন ভাবেই যৌক্তিক হবে না যে, ১৮৩২ সালে রংপুরে পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন


Link copied