শেখ মাজেদুল হক
স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে বাঙালি জাতির জন্য পদ্মা সেতু এক বিরাট অর্জন। বাংলাদেশের যতগুলো অর্জন এবং গর্ব, মর্যাদা, অহংকার তার মধ্যে পদ্মা সেতুই সর্বেসর্বা। অত্যাধুনিক স্থাপত্য শৈল্পের পাশাপাশি এই সেতু প্রযুক্তি নির্ভর।কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। সেতুর উপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য পদ্মা সেতু। এই সেতু নির্মাণ নিয়ে নানা রকম জটিলতা জল্পনা-কল্পনার পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় অঙ্গীকারই আজকের এই সেতু ।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, যাতায়াত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব আনবে এই সেতু, একুশ জেলার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করবে এই সেতু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই সেতু কেবল যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজসাধ্য করবে তা নয় দেশের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে উন্নত, সুসংহত করবে। সত্যিকার অর্থে পদ্মা সেতু সব পরিচয় ছাপিয়ে বাংলাদেশের আত্ম মর্যাদার পরিচয় ধারণ করছে।পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে।পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চল জুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। এই সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের বৃহত্তম এই সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে রাজধানীসহ অন্যান্য অংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া এ সেতুটি ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।স্বপ্নের এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মংলা বন্দরের মাধ্যমে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্প যার অধিকাংশ খুলনা থেকে রফতানির মাধ্যমে আয় হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু হলে এই আয় আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, বেনাপোল, দর্শনা ও ভোমরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতির গতি সৃষ্টি হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়।এই সেতু চালু হলে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানী ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে।এই সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে, পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়াও স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবেন, এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালি সোপান হিসেবে কাজ করবে।
পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাড়বে জীবনযাত্রার মান ও কর্মসংস্থান। সেতুর একপ্রান্ত ছুঁয়ে থাকবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা। কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ন, জীবনমান বৃদ্ধি পাবে যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাবে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের শহর। কলকারখানায় ভরে উঠবে এ এলাকা। শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। এ সেতু নির্মাণের সুফল হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে এবং কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বয়ে আনবে সুসংবাদ।
পদ্মা সেতুর কারণে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। জীবন যাত্রার মান বেড়ে যাবে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। এই সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে।
এতে দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপ মালদ্বীপের মতো পর্যটন-উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগত তৈরি করা সম্ভব। পদ্মা সেতু চালু হলে সেই সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। পদ্মা সেতুর কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা, সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র ছয় ঘণ্টায়, ফলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশপাশে বেশ কিছু দ্বীপের সঙ্গে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। তাহলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন। এজন্য এরই মধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এবং এর আশপাশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে।
এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সেতুটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এক দশমিক দুই শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের জেলার প্রায় ছয় কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিত। এখন মঙ্গার কথা আর তেমন একটা শোনা যায় না। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের এই মঙ্গা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এখনও শিল্পের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ এলাকার বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে সবার আগে উপকার হবে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর। দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতুর তাৎপর্য শুধু আর্থ-সামাজিক প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটা বাঙালি জাতির আত্ম-মর্যাদা ও আত্ম-প্রত্যয়েরও প্রতীক, হিমালয় পদানত করার চেয়েও অধিক গৌরবের।শত বাধা, ষড়যন্ত্র, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, যন্ত্রণা, ইত্যাদি মোকাবিলা করে কিভাবে কাজ করে যেতে হয় তার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।সত্যি যোগ্য পিতার, যোগ্য কন্যা, দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
Email:smh.mkt@brur.ac.bd