আর্কাইভ  রবিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৫ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩২
আর্কাইভ   রবিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৫

শক্তি ও অনুপ্রেরণার নাম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

সোমবার, ৮ আগস্ট ২০২২, রাত ১১:৫৮

Advertisement

শেখ মাজেদুল হক

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুর শক্তি ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন তখন তার অবর্তমানে সংগঠন পরিচালনায় প্রধান সমন্বয়কারীর গুরুদায়িত্ব পালন করতেন বঙ্গমাতা। জেলগেটে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়ে নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর দিতেন। আবার জেলগেট থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত দিক-নির্দেশনাও নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-

‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুকে উজ্জীবিত করেছেন, ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুকে নির্ভিকচিত্তে দেশের কাজ করতে সাহায্য করেছে। আবার সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নির্ভীকচিত্তে দেশ ও দেশের জনগণের জন্য কাজ করতে সাহায্য করেছেন। বলা যায় বঙ্গবন্ধু, বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গমাতা একই সূত্রে গাঁথা। শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে লিখেছেন যে, “আমার জীবনে আমি দেখেছি, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী বাধা দেননি, এমনকি তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজটিও দেখিনি । আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি তবে কোনোদিন মুখ কালো করে থাকা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ, কিছুই করেনি । যদি এমন কিছু হত, তাহলে বোধ হয় জীবনে আমার অনেক বাঁধা আসত । এমনও হয়েছে যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারিনি আমার ছেলেমেয়েদের জন্য স্ত্রীর কাছে। আমার সংগ্রামে আমার স্ত্রীর অবদান যথেষ্ট রয়েছে, নয়তো আমার বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা হতোনা । রেনু আমার সহযোদ্ধা ।” অন্যদিকে কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহায়তা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন বাঙালি মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি সফলের ক্ষেত্রেও তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কলকাতায় অবস্থানকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত স্বামী শেখ মুজিবের যখনই অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো তখনই পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় পাঠিয়ে দিতেন তিনি।বঙ্গবন্ধুর ওপর জেল-জুলুম চালিয়েছে পাকিস্তান সরকার। ওই সময় নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলঙ্কার বিক্রি করেও দল ও নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবন-যাপন করতেন তিনি। তার বাড়িতেও কোনো বিলাসী আসবাবপত্র ছিলো না, ছিলো না কোনো অহংবোধ।

তার সদয় আচরণ ও বিনয়ে মুগ্ধ ছিল সবাই। সন্তানদের যেমন ভালোবেসেছেন তেমন শাসনও করেছেন। পিতা-মাতা উভয়েরই কর্তব্য পালন করে গেছেন তিনি। কোমলে কঠোরে মিশ্রিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সাহসী নারী স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্তানদের গড়ে তোলেন।তার কাছে সহযোগিতা চেয়ে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরে যায়নি। অনেক সময় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে পাওয়া অর্থ ব্যয় করে দরিদ্র ঘরের কোনো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বঙ্গমাতার বুদ্ধিমত্তার ছাপ। ওইদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে গতবছর বঙ্গমাতার জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চ ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে! সবাই এসেছে-এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আব্বাকে সোজা বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জান কী বলতে হবে? তোমার মনে যে কথা আসবে, সে কথা-ই বলবা।

এরপর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে তর্জনি উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার সেই ডাকেই স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ডাকে ছিল বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন। এই সমর্থন বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছিল। আজ এই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে।শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এই সময়টায় অনেকটা বন্দিদশায় কেটেছে তাদের। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর সেখান থেকেই লন্ডনে যান। লন্ডন থেকেই বেগম মুজিবের সঙ্গে তার প্রথম কথা হয়।১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এরপর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান তিনি। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দেন। স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গমাতা বলেন, ‘আমি তোমাদের মা। ’ তিনি বলেন, ‘এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের লজ্জা কিংবা গ্লানিবোধের কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই প্রথম প্রমাণ করেছেন যে, কেবল বাংলাদেশের ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদাবোধে কী অসম্ভব বলীয়ান। (দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)। ’এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে তুলে ধরতেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অবদান রেখেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশ সফরকালেও বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতেন তিনি।

সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক শেখ মুজিবের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে তাদের হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র।

বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যে কর্তব্যনিষ্ঠা, দেশপ্রেম, দূরদর্শী চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তার ফলে জাতির পিতার পাশাপাশি তিনি আজ বঙ্গমাতার আসনে অধিষ্ঠিত।বঙ্গমাতার আদর্শে গড়ে উঠুক এদেশের নারীরা। তার আদর্শে আপন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত হোক বাংলাদেশ। ৯২ তম জন্মদিনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি পরম শ্রদ্ধাঞ্জলি। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এভাবেই বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের সাহসী নারী হয়ে । 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানমা র্কেটিং বিভাগ।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।

smh.mkt@brur.ac.bd

 

 

 

মন্তব্য করুন


Link copied