ডেস্ক: সবুজ কার না ভালো লাগে। গাছ-গাছালি ভরা খোলামেলা মনোরম পরিবেশ, সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো খোলা আকাশ। যেখানে থাকবে না কোনো কোলাহল। যেখানে হারিয়ে যাবে মন। এমন আবহে হারিয়ে যেতে কে না চায়? এমন পরিবেশে যে কারও মন উতলা হয়ে কাশফুলের মতো ঢেউ খেলবে দক্ষিণা হাওয়ায়। তাইতো কবি লিখেছেন, ‘ও আমার বাংলা মা তোর/আকুল করা রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে, যায় জুড়িয়ে’। গ্রাম-বাংলার এমন প্রতিচ্ছবি কোনো অমূলক চাওয়া নয়। এটাই বাংলার আসল প্রতিচ্ছবি। তবে তা যদি হয় নগরায়নে?
রাজশাহী বাংলাদেশের একটি প্রাচীন শহর। আধুনিক শিক্ষানগরী বলা হয় এই শহরকে। শুধু শিক্ষানগরীই নয়, রাজশাহীকে ডাকা হয় সবুজনগরী, শান্তির নগরী, রেশম নগরী কিংবা সিল্ক সিটি নামে। যেখানে গড়ে উঠেছে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পদচারণা, চঞ্চলতা, কোলাহল, গল্প, আনন্দ, উল্লাস, ব্যস্ততা ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠে রাজশাহী।
রাজশাহী জেলায় ৩৬৭টি মাদ্রাসা, ১৯৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৯৮৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১১০টি কলেজ রয়েছে। দেশের একমাত্র পুলিশ একাডেমি ও পোস্টাল একাডেমিও এ জেলাতেই অবস্থিত। রয়েছে দৃষ্টিনন্দন রাজশাহী কলেজ। নতুন করে সাজানো এই কলেজ দেখলে মনে হতে পারে ইউরোপের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এছাড়া রয়েছে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ মতিহারের সবুজ চত্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। রাবির মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বিমোহিত হন বিভিন্ন জায়গা থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা। এছাড়া প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এক নজর দেখতে আসেন বহু দর্শনার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেট, টুকিটাকি চত্বর, ইবলিশ চত্বর, আমতলা, শহীদ মিনার, সাবাস বাংলা, গণকবর, রাকসু ভবন, স্টেডিয়াম ও একাডেমিক ভবনসহ প্রতিটি দৃশ্য নজর কাড়বে যে কারও। এছাড়াও এখানে রয়েছে নয়নাভিরাম প্যারিস রোড। যেখানে দৃষ্টি দিলেই চোখ ফেরানো কঠিন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, শিক্ষানগরী হিসেবে রাজশাহীর একটি খ্যাতি আছে। রাজশাহীতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এখানে সরকারি দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আরেকটির অনুমোদন পাওয়ার পর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে দুটি। এছাড়া রাজশাহী কলেজ প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন কলেজ। মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টেকনোলজি কলেজসহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এই নগরীতে।
পদ্মা বিধৌত হযরত শাহজালাল-শাহ মাখদুমের স্মৃতি বিজড়িত রাজশাহী হাজার বছরের প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন জনপদের অংশ হিসেবে পরিচিত ছিল। উত্তরবঙ্গের অন্যতম এই বড় শহর অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগরী। তাইতো বিশ্ব দরবারে গ্রিন সিটি হিসেবে রাজশাহীকে পরিচিত করেছে অনেক আগেই। এরইমধ্যে ইউনেস্কো ঘোষিত পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগরী হিসেবে স্বীকৃত রাজশাহী।
দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে রাজশাহী অনেকের মন জয় করেছে। যা দেশের অন্য শহরগুলোর জন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে পরিষ্কার এবং বায়ুদূষণ মুক্ত শহরগুলোর মধ্যে প্রথমদিকেই রয়েছে রাজশাহী শহর। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা দ্রুত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বে এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী শহর। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
রাজশাহীর সৌন্দর্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর পুরনজিত মহালদার বলেন, বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক ও ছাত্র হিসেবে রাজশাহীকে দীর্ঘদিন ধরে দেখছি। ২২ থেকে ২৩ বছর আগে রাজশাহীতে এসেছি। তখনকার রাজশাহী আর বর্তমানের রাজশাহী আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বর্তমান রাজশাহীকে আমরা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, পুরো বিশ্বের একটা রোল মডেল শহর হিসেবে দেখতে পারছি। বর্তমান রাজশাহীর সৌন্দর্য ও পরিবেশ এবং ইতিবাচক দিকগুলো ও পরিকল্পিত নগরায়ন ব্যবস্থাপনায় যারা কাজ করছেন, শিক্ষক হিসেবে তাদেরকে সাধুবাদ জানাই।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবুজে মোড়ানো এই শহরের সাফল্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিকল্পিত নগরায়ন ও বৃক্ষরোপণ। এছাড়া নগর উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও জিরো সয়েল প্রকল্প গ্রহণ অন্যতম। সিটি করপোরেশনের দক্ষ কর্মী ও চৌকস পরিচালনায় শহরের যেকোনো ময়লা-আবর্জনা নিমিষেই পরিষ্কার করা হয়। শহরের অভ্যন্তরে কোথাও ময়লা আবর্জনার স্তূপ সাধারণত চোখে পড়ে না। কোথাও দেখা গেলেও তা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয়। যার ফলে এই ময়লা-আবর্জনা শহরের বাতাসকে দূষিত করতে পারে না।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, এই শহরকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রক্রিয়া আমাদেরকে ধরে রাখতে হয়েছে। শহরের এই পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়ন তো একদিনে হয় না। এগুলো করতে আমাকে অনেক পদ্ধতি বের করতে হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এখন এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। মানুষজন বলছেন যে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বসবাসযোগ্য নগরী রাজশাহী। এটা শুনলে আমাকে খুব ভালো লাগে।
এছাড়া রাস্তাঘাটের উন্নয়ন রাজশাহী শহরকে করেছে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত। শহরে নামলেই দেখা মিলবে প্রধান সড়ক বিভাজক দিয়ে লাগানো সারি সারি দৃষ্টিনন্দন গাছ। এর ভেতর লাগানো হয়েছে রঙ্গন, কাঠ করবি, চেরি ও এ্যালামুন্ডা। সব নিচে লাগানো হয়েছে সবুজ হেজ। এরপর কাঠ ও বাঁশের আদলে তৈরি করা হয়েছে কনক্রিটের বেড়া। এছাড়া নগরীর এই সৌন্দর্য ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে অবৈধ পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন। অন্যদিকে নগরীর ফুটপাথের ওপর সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সব ধরনের ব্যবসা বন্ধ করেছে রাসিক। সব মিলিয়ে এক দৃষ্টিনন্দন নগরী হয়ে উঠেছে রাজশাহী।
এরআগে দেশ ও দেশের বাইরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ রাজশাহী সফর করেছেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়নে রাজশাহীর প্রশংসা করেছেন অনেকেই। কিছুদিন আগে রাজশাহী সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাস। এ সময় তিনি পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগরী রাজশাহীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। হাস বলেন, ‘আমি রাজশাহীর সপুরা সিল্ক, মেট্রোপলিটন পুলিশের অফিস, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, সাইবার অ্যান্ড সিকিউরিটি ট্রেনিংয়ের কার্যক্রম, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, আমেরিকান কর্নার ইত্যাদি পরিদর্শন করেছি। মেয়রের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত রিনা পি সোয়েমারনো রাজশাহী সফরে গিয়ে বলেন, ‘এখানকার চমৎকার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখে আমি মুগ্ধ। এখানকার মানুষদের ভালো লেগেছে। এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।’
এছাড়াও কয়েকদিন আগে রাজশাহী সফরে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ সময় তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শান্তির শহর হিসেবে রাজশাহী মহানগরীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাজশাহীকে দৃষ্টিনন্দন রাজশাহী বানিয়ে দিয়েছেন সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সব কিছুই পরিপাটি। রাজশাহীতে যতবার এসেছি, ততবার মুগ্ধ হয়েছি। ততবার মনে হয়েছে শান্তির জায়গায় এসেছি, ভালোবাসার জায়গায় এসেছি, একটা নতুন সুন্দর পরিবেশে এসেছি।
রাজশাহীর সৌন্দর্য নিয়ে কেউ প্রশংসা করলে কেমন অনূভুতি হয় এমন প্রশ্নের জবাবে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, সরকারি পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অথবা দেশের বাইরের কোনো নাগরিক যদি রাজশাহীতে আসেন এবং এই শহর সম্পর্কে খুব ইতিবাচক মন্তব্য করেন, তখন আমার খুবই ভালো লাগে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর বলেন, ছাত্ররা যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিষ্কার রাখেন, আমার পরিবার যদি রাজশাহী শহরকে পরিষ্কার রাখে, বাইরে থেকে এই শহরে আসা মানুষজনের সঙ্গে এখানকার যানবাহন চালক ও খাবার হোটেলের মালিকরা যদি ভালো ব্যবহার করেন, খাবারের মান যদি ভালো হয়, তাহলে দিন দিন আমরা দেখতে পারব সব ক্ষেত্রেই রাজশাহী নগর আসলেই বিশ্বের একটা রোল মডেল শহর হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। রাজশাহী একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নগর হিসেবে দিন দিন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটুক- এই প্রার্থনা করি। রাজশাহীকে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাজশাহীবাসীর প্রচেষ্টা সফল হোক। ভালোভাবে বাঁচি আমরা। বাঁচার মতো করে বাঁচতে চাই আমরা।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়নে এগিয়ে থাকলেও শিল্পায়নে অনেক পিছিয়ে রাজশাহী। ফলে এ অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রার মানও খুব বেশি ভালো না। শিল্পায়ন না হওয়া একটি বড় সমস্যা তুলে ধরে সিটি মেয়র বলেন, রাজশাহীতে শিল্পায়ন হয়নি। এই জনপদে এটি একটি বড় সমস্যা। এছাড়া, এখানে বড় কোনো বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় না। এখানে মূলত কৃষি নির্ভর অর্থনীতি বিরাজমান। কৃষি পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। সেগুলো বাজারজাতকরণের মাধ্যমে রাজশাহীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এর পাশাপাশি এখানে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য অনেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে এবং আরও নতুন নতুন চালু হতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে এসে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন। তাদের এই পদচারণার কারণেও এখানে একটি অর্থনৈতিক লেনদেন হয়। আগামী দিনে চিকিৎসাসেবাসহ আরও অনেক কাজ করে রাজশাহীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শিল্পায়নের যে বিষয়গুলো রাজশাহীর জন্য প্রযোজ্য, অর্থাৎ কৃষি নির্ভর শিল্পকারখানা রাজশাহীতে করার ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছি।
শিল্পায়নের উন্নয়নে করণীয় প্রসঙ্গে পুরনজিত মহালদার বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ সব দিক থেকেই রাজশাহী নগরকে একটা সুষ্ঠু আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাঁড় করাতে যাচ্ছি আমরা। আমাদের প্রশাসন সেটার জন্য চেষ্টা করছে। সেই জায়গায় রাজশাহী শহরের নাগরিক হিসেবে আমাদের নিজেদেরও অনেক কর্তব্য রয়েছে। ধাপে ধাপে যে প্রক্রিয়াগুলো আসবে, সেগুলো একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের যতটুকু দায় আছে, সেই দায়টুকু যেন আমরা সবাই পালন করি। খবর-সময় সংবাদ