শেখ মাজেদুল হক
প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয় কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না। আজ এই ধরায় বাড়ছে জনসংখ্যা কমছে মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। যার মান এবং হুঁশ আছে তাকেই মানুষ বলা হয়। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। মানুষ যা পারে আর কেউ তা পারে না । প্রতিটি মানুষের উচিত মনুষত্ববোধ থাকা। লোভ হিংসা অহংকার মুক্ত জীবন ধারণ করা।
একজন ডিগ্রিধারী ব্যক্তিত্বের চাইতে একজন বিবেকবান সম্পন্ন ,মনুষ্যত্ববোধ মানুষ পরিবার, প্রতিষ্ঠান ,দেশ এবং সমাজের জন্য অধিক নিরাপদ। ভালো ছাত্র, ভালো শিক্ষক ,ভালো ডাক্তার ,ভালো ইঞ্জিনিয়ার ,ভালো ব্যবসায়ী হওয়ার আগে সকলকে ভাল মানুষ হওয়া প্রয়োজন ।কারণ একজন ভালো মানুষই ভালো অভিভাবক হতে পারে ,ভালো বাবা হতে পারে ,ভালো ভাই হতে পারে, ভালো ডাক্তার হতে পারে ,ভালো শিক্ষক হতে পারে ,ভালো শিক্ষার্থী হতে পারে।
সমাজ শুধু মাত্র সার্টিফিকেট ধারী অধ্যাপক, সচিব, আমলা, ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার, স্যার ,ব্যবসায়ী তৈরি করবে না ।ভালো মানুষ হওয়ার পিছনে পারিবারিক ,সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন দুর্জন বিদ্বান হইলেও উনি পরিত্যাজ্য। সমাজ সংসারে সেবা দানকারী ভালো মানুষের বড়ই প্রয়োজন। টাকা পয়সা ,বাড়ি গাড়ি ,সম্পদ কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয় ।মৃত্যুর পর মানুষ শুধু মনে রাখবে মানুষের ভালো কর্মগুলো ।সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের উচিত দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ জাতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই বাংলাদেশকে আরো বেশি বাসযোগ্য করে যাওয়ার। বিবেককে জাগ্রত করে ভালো-মন্দ ন্যায় অন্যায় বিচার করে পরিচালিত হওয়া। অপরের সুখে সুখী হওয়া ,পরের দুখে দুঃখী হওয়া।
সুখ আর ক্ষমতার অভিলাষে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে মানুষ নিরন্তর ঐশ্বর্যের পিছনে ছুটে চলেছে। এই চলা যেন সময়ের পরিক্রমায় অদম্য থেকে অদম্যতর হয়ে উঠেছে। ঐশ্বর্য কি মানুষকে মুক্তি দিবে? এ প্রশ্ন এখন অবান্তর। নিতান্তই বোকা বোকা মনুষ্যত্ব বিবর্জিতদের কাছে সকল সুখ শান্তির চাবি-কাঠি ঐশ্বর্যে। ঐশ্বর্যের অহংকারে, ক্ষমতার অহংকারে মানুষকে যথাযথ মূল্যায়ন করার ন্যূনতম স্পৃহাও আজ লোপ পেয়েছে। মনুষ্যত্ব বিবর্জিত হয়ে ঐশ্বর্যের সন্ধানে মানুষ সদামত্ত। তারা ভুলতে বসেছে মনুষ্যত্ব বিবর্জিত ব্যক্তি পশুর সমান।
মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোপরি ধর্মীয় শিক্ষা মনুষ্যত্ব অর্জনে সহায়তা করে। ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহাশয়ের লেখনিতে অহিংসা, অচৌর্য্য, শুচিতা, সংযম ও সত্য এই পাঁচটি গুণ অর্জন করে মনুষ্যত্ব লাভের কথা বলা হয়েছে। অহিংসা চর্চাকারী ব্যক্তিরা অন্যকে পীড়ন করা, অন্যের ক্ষতির চিন্তা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, ঈর্ষা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকেন।
অচৌর্য অর্থ চৌর্য্যবৃত্তি থেকে বিরত থাকা। দেশে প্রচলিত আইনে চুরিকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তার সাথে অবৈধ উপায়ে মানুষ ঠকিয়ে উপার্জিত অর্থ সম্পদও এর আওতাভূক্ত।
শুচিতা অর্থ পবিত্রতা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা। ইসলাম ধর্ম মতে, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। হিন্দু ধর্ম মতে পবিত্রতা ধর্মের অঙ্গ বাহ্যিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পবিত্রতার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। অভ্যন্তরীণ অর্থাৎ মনোজাগতিক দিক দিয়ে যিনি পবিত্র তার পক্ষে খারাপ চিন্তা করা বা কাজ করা সম্ভব নয়। বর্তমান সমাজ ব্যভিচারের মত ব্যধিতে আক্রান্ত। মনের দিক থেকে শুচিতা রক্ষাকারী ব্যক্তির পক্ষে এ ধরনের কাজ চিন্তারও অতীত ।
সংযম অর্থ চিন্তায়, কথায় ও কাজে সর্বদা আত্মনিয়ন্ত্রিত থাকা। পঞ্চ ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক) ও ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য্য) (কাম অর্থ লালসা, ক্রোধ অর্থ রাগ, লোভ অর্থ লোলুপতা, মদ অর্থ দাম্ভিকতা, মোহ অর্থ আসক্তি, মাৎসর্য্য অর্থ ঈর্ষা) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংযমী হওয়া সম্ভব।
সত্য কোন কিছুর হুবহু প্রকাশ করা হলো সত্য। অর্থাৎ কোন কিছু গোপন না করে, মিথ্যা বা কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে সম্পূর্ণভাবে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করা হলো সত্য, আর সত্যের পথে পরিচালিত, সত্যকে প্রায়োগিক জীবনে প্রতিফলন ঘটিয়ে জীবন যাপন করা হলো সততা। সৎপথে থেকে, সত্যের পথ অবলম্বন করে, সত্য প্রকাশ করা হলো সত্যবাদিতা। সততা ও সত্যবাদিতা হল মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। সত্যবাদী মানুষের পক্ষে প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন অপরাধ সংঘটন করা সম্ভব নয়।
আর এভাবেই ত্যাগ ও সেবার মানষিকতায় উজ্জীবিত হয়ে উল্লেখিত পাঁচটি (অহিংসা, অচৌর্য্য, শুচিতা, সংযম ও সত্য) গুণের চর্চা করে মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমে আকৃতিগত মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে সার্থক ও কল্যাণকর মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব। তাইতো কবি বলেছেন, যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে ,কেঁদে ছিলে তুমি হেসেছিলো সবে ,এমন জীবন করো হে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, মার্কেটিং বিভাগ।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।
smh.mkt@brur.ac.bd