আর্কাইভ  শনিবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩২
আর্কাইভ   শনিবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৫

নির্বাচনী হলফনামা কেবলই আনুষ্ঠানিকতা?

শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, রাত ১০:২০

Advertisement

এহ্‌সান মাহমুদ

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুসারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থীদের একটি হলফনামা দিতে হয়। তাতে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ও আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য থাকে। সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিসের দায়িত্ব হলো, এসব হলফনামা ভোটারদের নজরে আনা। যাতে ভোটাররা তাঁদের ভোট দেওয়ার আগেই প্রার্থী সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারেন।

তবে প্রায়ই দেখা যায়, আর্থিকভাবে বিত্তবান হিসেবে পরিচিত প্রার্থীরা হলফনামায় তাঁর চেয়ে স্ত্রীর সম্পদ অনেক বেশি দেখিয়ে থাকেন। রাজনীতিকদের কেউ কেউ হলফনামায় বলেছেন, তাঁর বাড়ি-গাড়ি কিছুই নেই। আবার প্রার্থী আইনজীবী বা ব্যবসায়ী হয়েও মাছ চাষ কিংবা কৃষিকে পেশা হিসেবে উল্লেখ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব তথ্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠাট্টা-মশকরা পর্যন্ত হয়েছে। অর্থাৎ, প্রার্থীরা হলফনামায় যে তথ্যগুলো উল্লেখ করেন, সেগুলোর সত্যতা অনেকাংশেই থাকে প্রশ্নবিদ্ধ।

এদিকে, নির্বাচন বিধিমালা অনুসারে, হলফনামার মাধ্যমে কোনো প্রার্থী তথ্য না দিলে, অসত্য তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করলে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে অথবা কারও আপত্তি আমলে নিয়ে তদন্ত করতে ও মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন। এ ছাড়া মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রমাণিত হলে প্রচলিত আইনে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু সমকালে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচন কমিশনই প্রার্থীদের হলফনামা যাচাই-বাছাই করেনি; দায়িত্ব এড়িয়ে চলছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমন তথ্য জানা গেছে। নির্বাচন কমিশন যাচাই করে না বলেই প্রার্থীরা হলফনামায় মনগড়া তথ্য দেন। এখন নির্বাচন কমিশন যদি এগুলো না দেখে, তাহলে এই হলফনামার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে - তবে এই হলফনামা কি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা? 

২০১৮-এর নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের একাংশের একটি প্রস্তাবের কথা এখানে স্মরণ করা যায়। তারা বলেছিল, নির্বাচনের আগে প্রার্থীর কাছ থেকে যে হলফনামা নেওয়া হয়, তার আর প্রয়োজন নেই। কেন প্রয়োজন নেই, সেই ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। এ ধরনের প্রস্তাবের পেছনে আর যা-ই হোক সৎ উদ্দেশ্য ছিল- এটা দাবি করা যাবে না। প্রার্থীদের হলফনামা কেন নেওয়া হয়? আগেই বলেছি, প্রার্থী সম্পর্কে যাতে ভোটার তথা দেশবাসী আগাম ধারণা পেতে পারেন। 

এখন নির্বাচন কমিশন যেভাবে দায় এড়ানোর জন্য বলছে, হলফনামা যাচাই করার মতো লোকবল বা সামর্থ্য তাদের নেই- এমন বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন দেখা যায়। নির্বাচনের আগে প্রাথমিক পর্যায়েই যদি কমিশন প্রার্থীদের যোগ্যতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তাহলে গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অংশগ্রহণমূলক না হলে তাকে যেমন নির্বাচন বলা যায় না তেমনি কোনো নির্বাচনে আইন ও বিধি অনুসারে অযোগ্য প্রার্থী জয় পেয়ে গেলে সেটি হয়ে পড়ে অর্থহীন নির্বাচন। 

ইসির দায়িত্ব নির্বাচন সুষ্ঠু করা। বিধিবিধান ও আইন তাকে ক্ষমতায়িত করেছে। আইনে যেসব অস্ত্র আছে, ইসি তা প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। 

তাই বর্তমান আইনে হলফনামার যে আট দফা রয়েছে, তার যথাযথ প্রতিপালন ও ক্ষেত্রবিশেষ পরিবর্তন আনা দরকার। ভোটারদের সামনে নির্বাচনে প্রার্থী বেছে নেওয়ার বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগেই হলফনামা যাচাইয়ের নিশ্চয়তা কমিশনের তরফ থেকেই আসতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইনের সংস্কার করতে উদ্যোগী হতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনী হলফনামাকে ব্যবহার করে রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, হলফনামার আইনি ভিত্তি আছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ সময়েই ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক নেতারা দুদক কিংবা রাজস্ব বোর্ডের সহজ শিকারে পরিণত হন। যদি শুরুতেই নির্বাচন কমিশন হলফনামা যাচাইয়ে মনোযোগী ও আন্তরিক হয়, তাহলে ভবিষ্যতে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। 

নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের মুখে প্রায়ই রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ম ভঙ্গের কথা শোনা যায়। দেশের রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের দায়ী করা হয়। কিন্তু কমিশন নিজেই দেখা যাচ্ছে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। হলফনামা যাচাই না করে কমিশন অতীতে যে ভুল করেছে, সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না- এটাই প্রত্যাশিত।

লেখক: সহ-সম্পাদক, সমকাল

মন্তব্য করুন


Link copied