এইচ.এম. আল- আমিন
সাহিত্যের সমৃদ্ধশালী ও জনপ্রিয়তম শাখা হলো উপন্যাস। জগতের বিচিত্র জীবনলীলা ও মানবমনের বহুমুখি গতি প্রকৃতির শিল্পসম্মত রূপ চিত্রিত করাই উপন্যাসের লক্ষ্য। বলা হয় উপন্যাস জীবনের এক সুসংবদ্ধ শিল্পিত রূপ। যাপিত জীবন সমস্ত সাহিত্যের মৌলিক উপকরণ।
শফিক আশরাফের 'পাউঠি' উপন্যাসে তাঁতশিল্পীদের যাপিত জীবনের বিচিত্র বর্ণনা পাই। গুলির শব্দ, পরপর কয়েকটা। ছোট দুটি বাক্যের মাধ্যমে উপন্যাসের সূচনা, এই বাক্য দুটি ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে, উপন্যাসের শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আবহের মধ্য দিয়ে,' মিলিটারি সব শেষ কইরা ফালাইব গো! পলাও! পলাও!'
আখ্যান নির্মানে শফিক আশরাফ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, পাউঠি উপন্যাসটিকে তিনি দুটি পর্বে বিভাজন করেছেন। প্রথম পর্ব অব্রুবাণ ও দ্বিতীয় পর্ব মূলত্রাণ। অব্রুবাণ নামটির সাথেই উপন্যাসের প্রথম পর্বের আখ্যানের সাজুয্য লক্ষ্য করা যায়। অব্রুবাণ শব্দের অর্থ -‘যাহার কথা বলিবার ক্ষমতা নেই,শিশু বালক’। এই পর্বে আমরা লক্ষ্য করি মতিউদ্দিনের বউ রঙমালার গর্ভে জন্ম হয় পুত্র সন্তান রফিকুলের। তার কান্নার আওয়াজ উপমা দিয়ে লেখন বর্ণনা করেছেন, " অবিরাম কান্নার শব্দ একঘেঁয়ে বাঁশির মতো বেসুরো বাজে।"
মতিউদ্দিন একজন তাঁতশিল্পী। সে ফজরের নামায পড়ে তাঁত বসায়। মতিউদ্দিনের কণ্ঠে লেখক তুলে এনেছেন তাঁতিদের নিত্যদের জীবনাচরণের বিচিত্র চিত্র। মতিদ্দিন সম্পর্কে লেখক বলছেন- "কয়েকবার জোরে জোরে আল্লাহর নাম নেয়। তারপর মোনাজাত করে। হে আল্লাহ নয়া তাঁত বহাইছি একটা। এইডার মধ্যে তুমি বরকত দিও।"
তাঁতিদের বয়নশিল্পের পিছনে রয়েছে কত সংগ্রামের গল্প লেখক তা তুলে এনেছেন 'পাউঠি' উপন্যাসে। তাঁতি ও তাঁতঘরের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এভাবে- " লম্বা তাঁতঘর সারাদিন খটাখট শব্দে তাঁত চলছে। তাঁতঘরের গন্ধটা একটু অন্য রকম। সুতো, কাপড়,মাড় ও শ্রমিকের গন্ধে ভরপুর তাঁতঘর।"
তাঁতিরা তাঁত বুনতো ধার দেনা করে, অনেক সময় মহাজনের কাছে বেশি দামে সুতো কিনে, কোনো কোনো সময় তারা বউয়ের গয়না বিক্রি করে তাঁত বুনতো। পাউঠি উপন্যাসের ভিতরে আমরা তেমনই বর্ণনা পাই। মতিউদ্দিনের মা মালেহা খাতুন ছলেকে জিজ্ঞেস করে - মতিউদ্দি কি হইছে বেটা? কুনু বালা খরব নি?
- হ মা, আমি তাঁত বহামো।
- তাঁত বহাবি! টাকা পাইবি কই?
মতিউদ্দি বলে- মা, রফিকের মা রাজি হইছে গয়না দিব।
'পাউঠি' উপন্যাসের প্রথম পর্বটি হয়ে ওঠেছে তাঁতিদের আত্মপরিচয়ের বিবরণ, তাদের জীবন কাঠামোর গল্প। মূলত্রাণ পর্বটি হয়ে ওঠেছে তাঁতি সম্প্রদায়ে বেড়ে ওঠা একটি সত্তা কীভাবে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলো তার বর্ণনা। অর্থাৎ তাঁতি সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া বালক রফিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে নীলফামারী কারিগরি কলেজে যোগদান করেন। রফিক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেও মূলকে কখনো ভুলে যান নি, তিনি তাঁতিদের নিয়ে গবেষণা করেন, খুঁজতে থাকেন তাঁদিদের জীবন সংগ্রামের ইতিহাস। রফিক আইরা নামের এক কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরে তাঁতিদের শিকড়ের সাথে মিল রেখে কন্যা সন্তানের নাম রাখেন শাড়িকা, ছেলে সন্তানের নাম রাখেন তন্তুজ।
পাউঠি উপন্যাসের মূলত্রাণ পর্বে তাঁতিদের সংস্কৃতির বর্ণনা পাই, রফিক আইরাকে বিয়ের পর যখন নিয়ে আসেন তখন মা-চাচিরা এসে ঘরে ঢোকার আগে তাদের পায়ে পানি ঢেলে দেয়, একটা কুলাতে দূর্বাঘাস, চাল,ধান দিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন পড়তে থাকে,তারপর কয়েকটা কাঁচা চাল তাদের খাইয়ে দেয়।
মূলত্রাণ পর্বের শেষ দিকে আমরা লক্ষ্য করি তাঁত শিল্পের বিলুপ্তির দিকটি, রফিক ছুটিতে বাড়িতে এসে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন- ' আব্বা তাঁত কই? মতিউদ্দি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,' আর তাঁত, তাঁত সব মইরা গেছে! তাঁতির উফরে অভিশাপ নামছে।'
'পাউঠি' উপন্যাসের পাঠে অনেব সময় মনে হয় লেখক নিজেকেই লিখেছেন। যদি আমরা উপন্যাসের চরিত্রায়নের দিকে নজন দেই তাহলে দেখবো, উপন্যাসের চরিত্র ও চরিত্রায়ন বহুমাত্রিক শিল্পসৃজনের শর্তসাপেক্ষ। 'পাউঠি' উপন্যাসে লেখন চরিত্র সৃজনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মতিউদ্দি,সোয়ালেব, সাকারিয়া, জুলহাস মুন্সি প্রতিটি চরিত্র উপন্যাসের গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। মালেহা, রঙমালা,আইরা প্রভৃতি নারী চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
সংলাপ বুননে দেখা যায় তাঁতিদের মুখের কথাকে লেখক শফিক আশরাফ তুলে এনেছেন। মতিউদ্দিন সোয়ালেবকে জিজ্ঞাসা করেন- গত হপ্তার বেবাক কাফর তো বেঁচা অয় নাই,ওইগুলো গুডানে বালা কইরা বইন্ধা রাখছিলি তো?
- হ বাই থুইয়া তে আইছিলাম।
মতিউদ্দির গলায় হতাশার চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে-
- তা বাঁচবো কেমনে তুমি কও,তুমি তো মেলা লেহাপড়া করলা। রাতারাতি সুতার দাম বান্ডিল প্রতি ২০০/৩০০ টেহা বাইরা যায়....সারাদিন তাঁত চালাইয়া তাঁতিরা আর ভাত পায় না।
পটভূমি ও প্রতিবেশ বর্ণনায় লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসে লেখক কল্পনাশক্তি ও বর্ণনাশৈলির দক্ষতায় নির্মাণ করেন পটভূমি ও প্রতিবেশ। 'পাউঠি' উপন্যাসের পটভূমি টাঙ্গাইল অ ল, প্রসঙ্গক্রমে নীলফামারী ও রংপুরের কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। উপন্যাসের অন্য নাম 'কথাসাহিত্য' শব্দ বা কথা সাজিয়ে জীবনের বহুচিত্র রূপচ্ছবি গড়ে তোলেন কথা শিল্লী। লেখক তাঁর ভাষাকে ব্যবহার করেন শব্দ, বাক্যবন্ধ, চিত্রকল্প, প্রতীক ও অলংকারের সাহায্যে।
'পাউঠি' উপন্যাসে লেখক শফিক আশরাফ চলিত রীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কোথাও কোথাও আ লিক কথ্য ভাষার ও প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। চিত্রকল্পের প্রয়োগ ও ঘটিয়েছেন লেখক- " রফিকের মনে হলো সে একটা কবরস্থানে প্রবেশ করছে। তাঁতগুলো নীরব নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে।"
উপন্যাসের নামকরণ মজাদার। উপন্যাসের শুরুতে পাউঠি কথনে লেখক বলেছেন- "পাউঠি তাঁতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁতির দু'পায়ের নিচে দুখণ্ড কাঠ। পা ঠেকানোর কাঠ বলেই হয়তো কোনো এক তাঁতি এর নাম দিয়েছিলেন পাউঠি। কাপড় বুননের সময় পাউঠির একটাতে চাপ দিলে সানার ভেতর দিয়ে আসা সুতোর একটা লেয়ার ওপরে উঠে যায় আরেকটা নিচে নেমে থাকে,মাঝ দিয়ে মাকু একটা সুতো নিয়ে একপাশে ছুটে যায়। আবার পাউঠির অন্য পা চাপ দিলে সুতোর ওপরের লেয়ার নিচে চলে আসে নিচেরটা উপরে যায়, মাঝ দিয়ে মাকু ছুটে যায় সুতো নিয়ে। এভাবে কাপড়ের বুনন চলে।"
পাউঠি দিয়ে শুধু তাঁতিরা কাপর বুনন করেন না, এটা দিয়ে তারা স্বপ্ন বুনে, তাদের আশা ও ভরসা এই পাউঠি। পাউঠির মাধ্যমে তাঁতশিল্পীদের রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়। উপন্যাসের শেষে লক্ষ্য করি পাউঠির কাজ বন্ধ থাকায় রফিকের মেয়ে শাড়িকা বাবাকে জিজ্ঞেস করে," বাবা এগুলো সব বন্ধ কেন?
রফিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাকরুদ্ধ কন্ঠে উত্তর দেয়," জানিনা মা,ওরা সব কোথায় গেল! আমি তো ওদের খুঁজছি।"
পাউঠি একটি গোষ্ঠীর জীবনের লালিল স্বপ্নের সাথে যুক্ত, সর্বোপরি উপন্যাসের নামকরণ পাউঠি যুক্তিযুক্ত।
লেখক: সাহিত্য সমালোচক ও সাবেক শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
মেইল: alamin521153@gmail.com