শেখ মাজেদুল হক
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগার এই রংপুর। ইতিহাস খ্যাত বিপ্লবী নারী দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠক, রাজা শিবচন্দ্র, বাকের জং, মনিসিং রংপুর থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ইংরেজ মারার লক্ষ্যে ট্রেনে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন সেটিও রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ভূতছাড়া (বর্তমান মীরবাগ) রেল স্টেশনে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ হন রংপুরের কিশোর যোদ্ধা শঙ্কু সমদ্দার। শহীদ শঙ্কুর আত্মত্যাগ মূলত রংপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন করে উজ্জীবিত করে। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল রংপুরের হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষ তীর, ধনুক, ছুরি, বল্লম ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে। কয়েকশ’মানুষ এতে পাকিস্তানী বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে শহীদ হয়। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের মতো অসীম সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
প্রবাদ ছিল, ‘রঙে রসে ভরপুর, তার নাম রংপুর’। এক সময়ে কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের মানুষের গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছিল। ছিল সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ভিত। নানা কারণে সময়ের পরিবর্তনে সে সমৃদ্ধি মঙ্গায় রূপ নেয়। এ এলাকাটিতে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হওয়ায় অনেকে বেকার থাকত। তাছাড়া চৈত্র-বৈশাখ ও আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফসলের জমিতে কোন কাজ থাকত না। ফলে উপার্জন না থাকায় এই সময়টা চরম কষ্টে দিন কাটাত এ এলাকার শ্রমজীবী মানুষের। বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রংপুরের মঙ্গা নিরসনের জন্য গবেষণার মাধ্যমে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আগাম জাতের ধান উৎপাদন, বহুমুখী ফসল উৎপাদন, সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ প্রদান, অনাবাদি জমিতে বিকল্প ফসল উৎপাদন, চরাঞ্চলের পতিত জমিতে ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া চাষ, বীজ, সার, কীটনাশকসহ সকল কৃষি উপকরণের সুলভ মূল্য এবং সহজলভ্যতা ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে নির্মিত বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতু, তিস্তা নদীর উপরে তিস্তা সড়ক সেতু, শেখ হাসিনা সেতু এবং ধরলা নদীর উপরে ধরলা সেতু এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক দরিদ্র চাষীর সকালের তোলা ফসল বিকেলেই বিক্রি হচ্ছে ঢাকার বাজারে। ফলে পণ্য বিক্রয়-বিপণন সুবিধা বেড়ে যাওয়া কৃষক পাচ্ছে ন্যায্য দাম।
রংপুরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রধান দাবি ছিল, রংপুরকে বিভাগ ঘোষণা, রংপুরে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, শিক্ষা বোর্ড স্থাপন, রংপুর পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীতকরণ। রংপুরকে বিভাগ ঘোষণা, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, রংপুর পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীতকরণ এই তিনটি দাবি পূরণ করেছে বর্তমান সরকার। কিন্তু রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এখনো গঠন হয়নি একটি শহর আধুনিকায়ন করার জন্য রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিকল্প নেই।
২০০৮ সালে রংপুর জেলা স্কুল মাঠে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দেন। সেখানে তিনি বলেন, আমি রংপুরের পুত্রবধূ। কাজেই রংপুর আমার নিজের জেলা। রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে নিলাম। রংপুরের উন্নয়নের জন্য আমার কাছে কোন দাবি বা সুপারিশ করার প্রয়োজন হবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২ আগস্ট ২০২৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো রংপুরে জিলা স্কুলে জনসভায় আসছেন। যেখানে প্রায় ডজন দুয়েক প্রকল্পের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। সেই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে রংপুরবাসী আরো কিছু প্রত্যাশা আছে।
আমরা সকলেই অবগত আছি, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি ছিল রংপুর বিভাগের আওতাধীন কুড়িগ্রাম জেলায়। এ জেলায় দারিদ্র্যের হার ছিল ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ, অর্থাৎ জাতীয় দারিদ্র্য হারের দ্বিগুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপ (প্রাথমিক) ২০১৬-এর তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দেশে শীর্ষ ১০টি দরিদ্র জেলার পাঁচটিই রয়েছে রংপুর বিভাগে। এ বিভাগের কুড়িগ্রামে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার দরিদ্র। এছাড়া দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, গাইবান্ধায় ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, রংপুরে ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং লালমনিরহাট জেলায় ৪২ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। কোনো প্রশাসনিক বিভাগ বা অঞ্চলে দারিদ্র্য হ্রাস বা বৃদ্ধিতে ইকোনমিক ইউনিটের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।
রংপুর অঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ, দ্রুত গ্যাস সংযোগ, স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ, ফার্নেস অয়েলে ভর্তুকি, কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, রংপুর বিভাগে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে আলাদা শিল্প, কর, ভ্যাট, শুল্ক ও ঋণ নীতি ঘোষণা, ট্যাক্স হলিডের মেয়াদ বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান, বিনিয়োগ সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য রিসার্চ সেন্টার স্থাপন, সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া-রংপুর হাইওয়ের পাশ দিয়ে রেল লাইন নির্মাণ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধাসহ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল জোন ও ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন, জ্ঞান ভিত্তিক শিল্প প্রসারের উদ্যোগ, কুড়িগ্রাম-ফুলছড়ি-জামালপুর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্রীজ নির্মাণ, আন্তঃনগর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি, কৃষিভিত্তিক রংপুর অঞ্চলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, অঞ্চলভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যবস্থার প্রচলন, কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিশেষ নীতি সহায়তা প্রদান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে পিছিয়ে পড়া রংপুর বিভাগে জনসংখ্যার অনুপাতে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত স্থাপন, রংপুর বিভাগ থেকে দ্রুত গতির ইলেকট্রনিক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করণ, রংপুর বিভাগের উন্নয়নের স্বার্থে নর্থবেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট মিনিস্ট্রি গঠন, চা শিল্পের উন্নয়ন, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও বিমান বন্দরচালু করণ, বেনাপোল স্থল বন্দরের ন্যায় রংপুর বিভাগে অবস্থিত সকল স্থলবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, রংপুর অঞ্চলে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে কম্প্রিহেনসিভ ইনভেষ্টমেন্ট পলিসি গ্রহণ, প্রতি জেলায় স্পেশাল ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা, পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের জন্য বিশেষ স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ প্রদান এবং পণ্যভিত্তিক শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় সহায়তার দাবি জানাচ্ছি।
এছাড়াও রংপুরে যা বাস্তবায়ন করা দরকার- অতিদ্রুত/ শীঘ্রই বাস্তবায়ন করা উচিত বলে আমরা সকলেই মনে করি ।তাহলেই রংপুর অন্যান্য বিভাগের মত আরো বেশি এগিয়ে যাবে ।এখানকার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন ঘটবে ।মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে ।মানুষ রাজধানীর দিকে না ছুটে এই রংপুরে থেকেই তারা তাদের কর্মসংস্থান এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারবে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা, অর্থনৈতিক অঞ্চল, নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, অত্যাধুনিক রেল জংশনসহ রেল যোগাযোগ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের আঞ্চলিক উপকেন্দ্র চালু, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তদেশীয় রেল স্টপেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে দুর্নীতিমুক্ত ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করণ অতীব জরুরী।। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদ চালু করে ও বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে আরো কিছু বিষয় যুক্ত করে নতুন করে ঢেলে সাজানো যায় রংপুরের বর্তমান এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। এতে কৃষি ও প্রযুক্তি শিক্ষার কলেবরও বৃদ্ধি পাবে আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সীমাবদ্ধতাও দূর হবে। আর আশপাশের আরো জমি অধিগ্রহণ করে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক অবয়ব দেওয়া যাবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যয়ে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির গুণগত মান ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা বেশি দরকার। একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ হতে অনেক সময় লাগে। একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চালানোর চেয়ে যেটা আছে সেটার উন্নয়ন করাই যুক্তিযুক্ত। পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় গ্যাসভিত্তিক ইউরিয়া সার কারখানা, সিরামিক শিল্প, ওষুধ শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প, অটো অ্যাসেম্বলি শিল্প ইত্যাদি গড়ে উঠতে পারছে না। রংপুর বিভাগের অর্থনীতি ও মানুষকে দেশের উন্নয়নের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এ বিভাগের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ও সঠিক উপকারভোগী নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জনসভা সফল ও সার্থক হোক এবং রংপুরের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় এমনটি প্রত্যাশা করছি।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) ও সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ; বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
Email: smh.mkt@brur.ac.bd