ডেস্ক: দেড় হাজার ছাত্র-জনতার লাশ এবং অসংখ্য মানুষের আহত মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে পলিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার পলায়নের পাঁচ মাস পূর্ণ হলেও এখনো তিনি গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোথাও মুখ দেখাননি হাসিনা। তবে কি লজ্জায় তিনি মুখ দেখাচ্ছেন না? এমনকি তিনি আসলেই ভারতে আছেন কিনা এবং ভারতে থাকলে কোথায় আছেন তা নিয়ে রয়েছে ধোয়াশা।
২০২৪ সালের শুরুতে ডামি নির্বাচনে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মাত্র ৭ মাসের মাথায় তীব্র জনরোষে গত ৫ আগস্ট গদি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন টানা চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪, ২০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে সরকার গঠনের পর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি বিতর্কিত ডামি নির্বাচনে আবারও ক্ষমতা দখল করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর থেকে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হয়নি শেখ হাসিনাকে। হঠাৎ করেই চলে আসে কোটা সংস্কার আন্দোলন। আর সেটি তীব্র থেকে তীব্রতর হলে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে শেখ হাসিনা সরকার।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি কিছুটা সংস্কার করে। এরপর হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রিন সিগনাল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করার রায় দেন হাইকোর্ট। কোটা সংস্কারের দাবিতে আবারও শুরু হয় আন্দোলন। শুরুতে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। গত ১৪ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। এতে যেন আগুনে ঘি ঢালা হয়। এতে দাবানলের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগকে উসকে দেন। ছাত্রলীগ বহিরাগতদের নিয়ে আন্দোলনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা করে। সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের বারুদ ছড়িয়ে পড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এক রাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
১৬ জুলাই রংপুরে নিহত হন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দুই হাত উঁচু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পুলিশের ছররা গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর দৃশ্য মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তীব্রতা বাড়তে থাকে আন্দোলনের। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। লাশের মিছিল বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। পরবর্তী কয়েকদিন সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়। কারফিউ জারি করে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, ছররা গুলির পাশাপাশি তাজা গুলি ব্যবহার করে পুলিশ। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে শত শত ছাত্র-জনতা প্রাণ হারায়। ব্যাপক প্রাণহানি ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলন কিছুটা দমন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে আদালত কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্বহালের পরিবর্তে সংস্কার করে। ৫৬ শতাংশ থেকে কোটা ১০ শতাংশে নেমে আসে।
এদিকে, ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। বুলেট আর ব্যাপক প্রাণহানির মাধ্যমে রাস্তা থেকে আন্দোলনকারীদের কিছুটা সরাতে পারলেও ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে দেশের জনগণ। এর মধ্যে সামনে আসে ‘ভাতের হোটেল’খ্যাত ডিবি পুলিশে প্রধান হারুনের নাটক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ডিবি অফিসে বসিয়ে ভাত খাওয়ানো এবং সেই ছবি-ভিডিও প্রচার করা, তাদের দিয়ে জোর করে বিবৃতি আদায় করা হয়। মানুষ এতে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ফের রাস্তায় নামতে শুরু করে। সরকার আরও কঠোর হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ৪ আগস্ট মাঠে নামানো হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের। তীব্র জনরোষে ময়দানে টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সেনাবাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সেনাবাহিনীর বড় অংশ ছাত্র-জনতাকে গুলি করতে অস্বীকৃতি জানায়।
গত ৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের মানুষ শেখ হাসিনাকে গদি থেকে উৎখাতের জন্য গণভবনের দিকে ছুটতে থাকেন। শেখ হাসিনা গণভবন থেকে পালানোর জন্য মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পান। তীব্র জনরোষ থেকে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৮ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আমন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।