স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী॥ শিশুদের মেধাবিকাশ ও শিক্ষাস্তরের প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। কিন্তু অভিভাবকদের সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর প্রতি আস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে যেখানে বিনামূল্যে পাঠ্যের সু-ব্যবস্থা রয়েছে অন্যদিকে উচ্চ ফ্রি দিয়ে নিজের সন্তানদের প্রাইভেট সেক্টর স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন অভিভাবকরা। ফলে প্রতি বছরই প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থী ঝরে পরার হারও বেড়েছে উত্তরের জেলা নীলফামারীতে। বিশেষ করে গ্রামের স্কুলগুলোর পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরনের পথ খুঁছতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির জন্য এবার নীলফামারী সদরের পশ্চিম পঞ্চপুকুর জামতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে মাইকিং প্রচার শুরু করা হয়েছে।
এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন স্বয়ং নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান। তিনি ওই স্কুলটি পরিদর্শনও করেছেন।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ওই স্কুলের আশে পাশে ৫টি পাড়া রয়েছে। সেখানে বিভিন্নস্থরের ১৫টি স্কুল-মাদ্রাসা গড়ে উঠায় প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কোনঠাসা হয়ে পড়ে। গত বছর(২০২৪) ১১১ জন শিক্ষার্থী থাকলেও চলতি বছরে শিক্ষার্থী নেমে আসে ৫০ জনে। সচেতন মহল বলছেন অলিতে-গলিতে, বিল্ডিংয়ের কোণায় ব্যাঙের ছাতার মত কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা তারা সেরকম কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বহু আইন এসব কিন্ডারগার্টেনে উপেক্ষিত। কারণ তাদের নজরদারি করার কেউ নেই। বছরের শুরুতেই নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে তারা। আশপাশের এলাকার বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে চলে রীতিমত প্রতিযোগিতা।
এই সরকারি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ আর ঝরেপরা শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে বিদ্যালয়ের পুরো ভবননকে নতুন করে সাজাতে নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে রংতুলিতে পাঠ্য বইয়ের বিভিন্ন বর্ণে অঙ্কিত করে সাজিয়েছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কোবাদ আলী সহ সহকারী শিক্ষকবৃন্দ। পাশাপাশি ঝরেপরা শিক্ষার্থীদের পুনরায় স্কুলমুখী করতে ভর্তি ক্যাম্পেইনসহ নানা আয়োজন করে যাচ্ছেন একের পর এক।
স্কুলতে কর্মরত ৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ বলছেন, শুধু মাত্র বেতনের জন্যই নয়, নিজেদের অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে কোমলমতি শিশুদের মেধা বিকাশে নিরলস ভাবে কাজ করছেন তাঁরা। প্রত্যন্ত এলাকায় এ বিদ্যালয়টি স্থাপিত হলেও, এটি একটি মডেল স্কুলে পরিনত করার প্রয়াস তাঁদের। তারা আরো বলেন, আমরাও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছি। আমাদের সন্তানরা পড়েছে। আমরা চাই প্রত্যেক শিশু যেনো শিক্ষা অর্জন করে।
কথা হলে বিদ্যালয়ের প্রধান কোবাদ আলী জানান, অন্যান্য শিক্ষকগণসহ সবার সহযোগিতায় এটি একটি মডেল স্কুলে পরিনত করার মানসিকতা নিয়েই এখানে কাজ করছি। ক্যাম্পিং করার কারনে স্কুলে এ পর্যন্ত ৮৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। আগামী দুই মাসে স্কুলে প্রায় দুইশতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাম্পিং করা হচ্ছে। তিনি জানান, আমাদের বিদ্যালয়ের ছাঁদে ওপেন এয়ার ও মাঠে ওপেন গ্রাউন্ড ক্লাস রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের আমরা পাঠ্যবইয়ের বিষয়গুলি প্রাকটিক্যাল করে পড়িয়ে বুঝিয়ে থাকি। বর্তমানে শৈত্যপ্রবাহ ও ঠান্ডার কারণে তা বন্ধ রয়েছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে তা পুনরায় শুরু হবে।
তিনি আরো জানান, এছাড়া আমরা বিদ্যালয়ে ইংলিশ ক্লাব, গণিত ক্লাব, কাব স্কাউট ক্লাব ও ডিবেট ক্লাবের ব্যবস্থা চালু করেছি। তাদের আমরা প্রাথমিকভাবে গড়ার চেষ্টা করছি। যেনো আগামী দিনে মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে।
এলাকাবাসী জানান, সরকারি স্কুলে আগে শিক্ষার্থীদের টিফিনে বিস্কুট দেয়া হতো। এখন সেটি বন্ধ। উপবৃত্তির টাকা শতভাব নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থী বাড়বে। না প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কিছু এলাকাবাসী কাছে অভিযোগ করে জানান, এলাকায় অনেকের এখন টাকা হয়েছে। নিম্ন থেকে মধ্য ও উচ্চ বৃত্ত আর্থিক অবস্থান হয়েছে তাদের। তারাই নিজেদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি করান না। তাদের ধারণা এখন এমন হয়েছে তাদের সন্তানের পাশে গ্রামের কৃষক-দিনমুজুরের সন্তানরা পাশাপশি বসে পড়বে এটা তারা মেনে নিতে পারে না। এই চিন্তা-ধারণা থেকে সকলে বেড়িয়ে আসতে হবে।
জামতলী এলাকার সচেতনমহলের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরাও চাই আমাদের এলাকার সন্তানরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করুক। এখানে উপবৃত্তিরও ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এলাকার অনেক কিন্ডারগার্ডেন স্কুল হয়েছে। বর্তমানে এলাকার ৮টি কিন্ডারগার্ডেন স্কুল রয়েছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি নির্দেশনা ও নিমমাবলী দিয়ে কিন্ডারগার্ডের স্কুলগুলি পরিচালিত হচ্ছে না। যদি সরকার কড়া নিদের্শনার সাথে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে তাহলে আজ পঞ্চপুকুর জামতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যে ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার প্রয়োজন হতো না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুমারেশ চন্দ্র গাছি জানান, জেলার প্রায় ১ হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে, কোমলমনি শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ আর ঝরেপরা শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে পশ্চিম পঞ্চপুকুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনেক গুলো ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যা নিত্যান্তই প্রশংসনীয়। তিনি জানান, আমরা এই ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ জেলা পর্যায়ে গ্রহণের চিন্তা নিচ্ছে। বিষয়টি আমি রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা উপপরিচালকেও জানিয়েছি। দ্রুত জেলা-উপজেলার প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণ এই উদ্যোগ গ্রহণ করার নিদের্শনা দেয়া হবে।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক মোঃ কোবাদ আলী শিশুদের মেধা বিকাশ আর ঝরেপরা শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। যা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে সকল প্রকার সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছি।