ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়,নীলফামারী॥ চলতি বছরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগে। নীলফামারী সহ উত্তরাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক ৫ জেলার প্রতিটি উপজেলার বোরো ক্ষেতের মাঠ দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ শ্যামলিয়ায় ভরপুর। ধান উৎপাদনও হবে বাম্পার আশাবাদী মাঠের কৃষকরা। এবার বোরো আবাদ বৃদ্ধির কারন হিসাবে কৃষকরা বলছেন বাজারে ধানের দাম ভাল পাওয়া যাচ্ছে।
অপর দিকে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে চলতি খরা মৌসুমে বোরো চাষে ব্যাপক সাফল্য এনেছে। প্রতিটি সেচখাল ভরপুর পানি। সেই পানিতে চলছে বোরো ক্ষেতে সেচ কার্যক্রম। নদীতে এখন পানি প্রবাহ ৩ হাজার কিউসেক ছেড়ে প্রায় ৫ হাজার কিউসেক প্রবাহ হচ্ছে। ফলে তিস্তার সেচে বোরো আবাদে পানির কোন ঘাটতি নেই।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করছে মাঠের কৃষকরা। সার, বীজসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণ হাতের নাগালে থাকায় দুশ্চিন্তাও নেই। সেচের পানিতেও নেই কোন ঘাটতি। সবার চোখেমুখে একটিই স্বপ্ন মাঠভরা বোরো ধানের সবুজ ক্ষেত। ধানের চারা রোপণের পর পরিচর্যায় সময় দিতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার(২০ মার্চ) সরেজমিনে দেখা গেছে, সেচ প্রকল্পের খাল নীলফামারীর ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারাজ থেকে শুরু হয়ে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলায় বিস্তৃত। মোট সেচ খালের দৈর্ঘ্য ৭৬৬ কিলোমিটার। প্রধান খাল, সেকেন্ডারি খাল, মেজর খাল ও সবশেষে টারশিযালী খালের মাধ্যমে বোরো জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে।
সদর উপজেলার রামনগর এলাকার বোরো চাষি তৈয়ব আলী(৪২) জানান, তিস্তার সেচে ৭ একর জমিতে বোরো আবাদ করছি। ফসলি জমিতে ইতোমধ্যেই বোরোর চারা রোপণ কাজ শেষ। এখন পরিচর্যা চলছে। বোরো শ্রমিক রফিক উদ্দিন(৩৫) জানান, বোরোতে শুধু কৃষকই নয়, শ্রমিকরাও লাভবান হয়। এসময় কাজের কোনো অভাব থাকে না। প্রতিদিন কৃষকের ক্ষেতে শ্রম দিলে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দিন মজুরি মেলে।
রংপুর কৃষি অঞ্চলের উপ-পরিচালক কার্যালয় দেয়া তথ্য সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো চাষ হয়েছে ৫ লাখ ৯ হাজার ৫৬ হেক্টর জমিতে। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৮ হেক্টর বেশী জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে নীলফামারীতে ৮১ হাজার ৮৫৯ হেক্টর, রংপুরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ১ লাখ ২৯ হাজার ২০ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৬২ হেক্টর ও লালমনিরহাটে ৪৮ হাজার ১৫ হেক্টরে। গত বছর(২০২৪) ৫ লাখ ৭ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। যা গত বছরের চেয়ে এবার ১ হাজার ২২১ হেক্টর জমিতে বেশী বোরো আবাদ হচ্ছে।
বাপাউবোর সূত্র মতে, উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২টি উপজেলায় সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর সক্ষমতা বহুলাংশে বাড়বে। তিস্তা সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন, সংস্কার ও পরিবর্ধন প্রকল্প'টির শেষ হওয়ার সময় ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এটি এখন দুই বছর সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজ শেষ হলে ২০২৭ সালের জানুয়ারী থেকে এক লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে।
তবে এদিকে ডালিয়া গ্রামের কৃষক আবু বক্কর অভিযোগ করে জানান, গত ৩০/৩৫ বছর ধরে তিনি তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানি দিয়ে ফসল ফলাচ্ছেন। তিস্তার পানিতে ফসল ফলাতে উৎপাদন খরচ কম হয়। সেচ প্রকল্প থেকে সারা বছর এক একর জমিতে তিন মাসের সেচের পানি নিতে তাদের দিতে হয়েছে দেড় হাজার(১৫০০) করে টাকা। তবে তিস্তা কমান্ড এলাকার কৃষক সমিতির নেতারা আমাদের কাছে অতিরিক্ত ৫২০ টাকা করে নিয়েছে একর প্রতি।
এবিষয়ে ওই এলাকার কৃষক সমিতির সভাপতি আব্দুস সামাদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, কৃষকরা সমিতির মাধ্যমে সেচের পানির টাকা পরিশোধ করেন। সমিতির মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করে সেচ এলাকার খাল পরিষ্কার ও নজরদারি করা হয়। এ কারণে কৃষকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়া হয়। সরকারকে নির্ধারিত দরে টাকা পরিশোধ করার পর বাড়তি টাকা সমিতির সদস্যদের কল্যাণে ব্যয় করা হয় বলেন তিনি।
তিস্তা সেচ প্রকল্পের উপসম্প্রসারণ কর্মকর্তা অমলেশ চন্দ্র রায় জানান, দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। এরমধ্যে নীলফামারী জেলায় ৩৩ হাজার হেক্টর, রংপুর জেলায় ১০ হাজার হেক্টর, দিনাজপুর জেলায় ৭ হাজার হেক্টর। যা একর হিসাবে ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৫০। তিনি আরও জানান, তিস্তা কমান্ড এলাকার সেচ খালে কৃষকরা আউটলেট থেকে পানি নেওয়ার জন্য মাঠ নালা তৈরি, তিন মাস সেচ গ্রহণ মজুরি ও বিবিধ বাবদ মোট ১ হাজার ৫০০ টাকা করে একর প্রদান করে থাকে। যা প্রতি মাসের সরকারি হিসাবে ৪০০ টাকা একর ও আদায় খরচ ২০% অতিরিক্ত হিসেবে ৮০টাকা সর্বমোট ৪৮০ টাকা প্রতি একর সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে। ওই পরিমান জমিতে সেচের জন্য সরকারি কোষাগারে পাঁচ কোটি ৯৩ লাখ ৪ হাজার টাকা রাজস্ব আয় করেছেন এবার।