আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ৩ এপ্রিল ২০২৫ ● ২০ চৈত্র ১৪৩১
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ৩ এপ্রিল ২০২৫
শুভেচ্ছাবার্তা:
উত্তর বাংলা ডটকম পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক ।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শহীদ

ঈদের আনন্দ নেই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাঈদের পরিবারে

মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল ২০২৫, রাত ০৯:৪৮

Advertisement

নিউজ ডেস্ক:  ঈদ ঘিরে ঘরে ঘরে আনন্দ। কিন্তু জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারগুলোতে নেই ঈদ আনন্দ। সবকিছু থেকেও স্বামী-সন্তান, স্বজনহারা পরিবারগুলোর চোখ জলে টলমল। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একেকজনের বুকভরা হাহাকার। এমন বেদনাবিধুর দিন কাটছে শহীদ আবু সাঈদের পরিবারেও। 

প্রথমবারের মতো আবু সাঈদকে ছাড়া ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেন বাবা-ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। যেই আবু সাঈদের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে মসজিদে যেতেন বাবা মকবুল হোসেন। এবার সেই সন্তানের কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছে তাকে। সন্তানের স্মৃতিতে ডুবে কবরের কাছে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। 

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের জাফরপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবু সাঈদ। বাবা মকবুল হোসেন একজন দিনমজুর। ছয় ভাইয়ের মধ্যে আবু সাঈদ ছিলেন সবার ছোট। তাদের তিন বোন রয়েছে। এর মধ্যে সুমি খাতুন সবার ছোট। 

আবু সাঈদহীন গ্রামের ছোট্ট বাড়িটিতে শূন্যতা ছেঁয়ে গেছে। ঈদের আনন্দ যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে পুরো পরিবারে। চারপাশে যখন সবাই ব্যস্ত ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে তখন আবু সাঈদের স্মৃতি বিজড়িত কথা মনে করে কাঁদছেন মা-বাবাসহ তার ভাই-বোনেরা।

পরিবারের সদস্যরা জানান, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ঈদের ছুটিতে বন্ধ হলে বাড়িতে ফিরে আসতেন আবু সাঈদ। সারাদিন ভাগ্নি-ভাতিজাদের সাথে আনন্দে দিন কাটতো তার। আবু সাঈদের বাড়িতে আসার খবর শুনে ছুটে আসতেন তার বন্ধুরা। তাদের সাথে দিনভর খেলাধুলা ও গল্পে সময় কেটে যেত আবু সাঈদের। প্রতিবেশী স্কুল-কলেজপড়ুয়া কেউ বাড়িতে এলে তার লেখাপড়ার খোঁজখবর নিতেন আবু সাঈদ। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সময় দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যেতেন। ঈদের আগের দিন ছোট বোনের বাড়িতে সেমাই-চিনিসহ ঈদের খাবারদাবার নিয়ে যেতেন। 

 

কিন্তু এবার কিছুই হয়নি এই পরিবারে। প্রতি বছরের মতো এবার ঈদ এলেও আবু সাঈদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের ঈদের নামাজ পড়া কিংবা ঈদের দিনে এক সঙ্গে খাবার খাওয়া হয়নি। আবু সাঈদের শূন্যতায় উঠানে ছিল তার ব্যবহৃত বাইসাইকেলটি। 

আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘ভাইকে ছাড়া এবারই প্রথম ঈদ করছি। ভাই বাড়িতে আসতো, আনন্দ-উল্লাসে দিন কাটতো। কিন্তু এবারের দিন আমাদের দুঃখ-বেদনার, কান্নার। আমার চঞ্চল ভাই বাড়ির আঙ্গিনায় চিরনিন্দ্রায় শায়িত। ভাইয়ের কবর দেখলেই চোখে পানি চলে আসে।’ এ কথা বলতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।  

তিনি বলেন, প্রতি বছর রমজানে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে ভাই বাসায় চলে আসতো। আবু সাঈদসহ পরিবারের সকল সদস্য মিলে ইফতার করতাম। ঈদের দিন সকালে ফজরের নামাজের পর আমি, বাবা, ছোট ভাইসহ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কান্না ভেঙ্গে পড়ি। আবু সাঈদসহ চব্বিশের অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের যেন আল্লাহ জান্নাত দান করেন। যেসব আহত ভাই রয়েছে, তারা যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে এই দোয়া দেশবাসীর কাছে চাইছি।

আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হাসান বলেন, ঈদের সময় নামাজ পড়া হতো বাড়ির পাশে বাবনপুর জামে মসজিদে। আমি, বড় ভাই, বাবা, আবু সাঈদ এক সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। এখন সেই মসজিদের নাম শহীদ আবু সাঈদ জামে মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে। এ মসজিদের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ এসেছে। দ্রুত দৃষ্টিনন্দন মসজিদে তা পরিণত হবে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন পরিবার থেকে আমরা কিছু খরচ দিতাম। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে সে চলতে পারতো না। সেজন্য সে রংপুরে টিউশনি করতো। টিউশনির টাকা কিছু বাঁচিয়ে ভাগ্নি-ভাতিজাদের ঈদের উপহার হিসেবে কাপড় কিনে দিত। এখন আমাদের কিছুটা হলেও টাকা পয়সা আছে কিন্তু সেই ভাই নেই, যাকে ঘিরে আমরা পুরো পরিবার স্বপ্ন দেখতাম।

ফেলে আসা ঈদের দিনগুলো মনে করে আবেগাপ্লুত ছোট বোন সুমি খাতুন বলেন, ভাই যতটুকু পারতো আমার বাচ্চা, বড় বোনের বাচ্চাদের জন্য জামা, মেহেদি কিনে আনতো। ঈদের সময় বাড়িতে এসে ছুটে যেত আমার শ্বশুরবাড়িতে। মনে হয় না যে ভাই আর নেই। মনে হয় এবারো হয়ত ভাই ঈদে বাড়িতে এসে আমার কাছে আসবে। ভাইয়ের হাসি, ভাইয়ের স্মৃতি কল্পনায় ভেসে ওঠে। মনে হয় ভাই এখনো জীবিত আছে।

সুমি বলেন, এবারের ঈদটা অনেক কষ্টে কাটছে। আগে আমাদের কোনো কিছুই ছিল না। যা পেতাম তাই ভাগাভাগি করে হাসিখুশিতে খেতাম। এখন হয়ত টাকা-পয়সা আছে অনেক। কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গে সেই ভাগাভাগিটা আর হবে না।

ঈদের দিন সকালে আবু সাঈদের প্রিয় খাবার ছিল গরুর মাংস করেন তার মা মনোয়ারা বেগম। কিন্তু সন্তানের প্রিয় খাবার সন্তানকে ছাড়া গলা দিয়ে কি আদৌ মানে?

আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আবু সাঈদ ঈদের সময় গরুর মাংস, পোলাও, সেমাই খেত। আমার হাতের রান্না তার অত্যন্ত পছন্দের ছিল। ঈদের সময় আবু সাঈদসহ তার ভাই-বোনদের নিয়ে আনন্দে সময় কাটতো। আজ আমার বুকের ধন নেই। একজন মা বোঝে তার সন্তান হারানোর কষ্ট। আমার ছেলেকে আল্লাহ যেন জান্নাত দান করেন।

আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, আবু সাঈদের জন্য কবরের পাশে শুধু কান্দি, আর আল্লাহর কাছে দোয়া করি। এখন সবাই আমার খোঁজ-খবর রাখে। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। আরও যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সকলের জন্য দোয়া করবেন। আমার ছেলে জীবন দিয়ে নতুন স্বাধীনতা এনেছে। একজন বাবার জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।

প্রসঙ্গত, আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ১২ ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। গত বছরের ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হন। ১৭ জুলাই বাবনপুরে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় তাকে।

আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে গুলি করার দৃশ্য দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হলে সারা দেশে আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।

মন্তব্য করুন


Link copied