আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ১৭ এপ্রিল ২০২৫ ● ৪ বৈশাখ ১৪৩২
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ১৭ এপ্রিল ২০২৫

মাদকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিশোর গ্যাং

বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫, সকাল ০৫:২৩

Advertisement

নিউজ ডেস্ক:  দেশজুড়ে বাড়ছে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা। বিগত দুই বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একই সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের হার বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নয়; বরং বদলে গেছে তাদের অপরাধের ধরন, প্রকৃতি।

মাদক সেবন, চুরি ও ইভ টিজিংয়ের সঙ্গে সমাজের বড় বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু-কিশোর। কিশোর অপরাধ নিয়ে সরকারি তথ্য ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এমন তথ্য পাওয়া যায়।

আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, কিশোর অপরাধ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও ছিল। তবে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপত্তি ও বিস্তৃতি নজরে আসার বিষয়টি খুব বেশি দিনের নয়।

২০১৭ সালে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান কবির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি সবার নজরে আসে। ২০১৯ সালে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে ‘জিরো জিরো সেভেন’ নামে কিশোর গ্যাংয়ের নাম ওঠে আসে। এরপর থেকে দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। আগে কিশোর অপরাধ বলতে একসঙ্গে ২৫-৩০ জন কিশোরের ঘোরাফেরা, হিরোইজমের জন্য মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ও চাঁদাবাজির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
যখন থেকে তারা মাদক ব্যবসা ও হত্যাকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে, তখন থেকে সমাজে কিশোর গ্যাং নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শুরু হয় ১৯৯০ সালের দিকে। ২০২৪ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ২৩৭টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা অন্তত দুই হাজার ৩৮২ জন। ২০২২ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ১৭৩টি, সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার।

অর্থাৎ দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বেড়েছে ৬৪টি বা ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে এসব গ্রুপের সদস্য বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার, যা আগের সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। তবে পুলিশ সদর দপ্তরে খোঁজ নিয়ে কিশোর অপরাধীদের পৃথক কোনো ডেটা পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পেলেও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকটি গবেষণা থাকলেও কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা রোধে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়, তারও বাস্তাবায়ন দেখা যায় না। ফলে ক্রমে মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে হত্যাযজ্ঞের মতো বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোর।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ জার্নালে প্রকাশিত ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে। ছয় বছরে এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। ২০২০ সালে অপরাধে জড়িত শিশুদের ৬১ শতাংশই ছিল ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে, যা ২০১৪ সালে ছিল ২৪.৭ শতাংশ।

২০২৩ সালে জার্নাল অব এমার্জিং টেকনোলজিস অ্যান্ড ইনোভেশন রিসার্চে (জেইটিআইআর) প্রকাশিত মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের ‘স্টাডি অব চিলড্রেন ক্রাইমস এট আরবান এরিয়াজ ইন বাংলাদেশ’ গবেষণায় বলা হয়, অপরাধে শিশুদের সম্পৃক্ততা বর্তমান সময়ে সত্যিই উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। তাদের মুষ্ঠিমেয়দের কর্মকাণ্ডে সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে শিশুদের ৭৫ শতাংশই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদকাসক্তি, মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, আগ্নেয়াস্ত্র বহন, ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো দরিদ্রতা ও শিক্ষার অভাব। অধিকাংশ শিশু ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সে অপরাধে যুক্ত হয়। যেসব অপরাধের জন্য শাস্তি অনিবার্য, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তাদের উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানো ছাড়া বড় কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না। কিশোর অপরাধের ধরন ও পর্যায় বিবেবেচনায় একটি দেশের আইনের শাসনের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়।

গবেষণায় অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৯০ শতাংশ মনে করে, দরিদ্রতার কারণেই কিশোর অপরাধ বাড়ছে। এ ছাড়া পারিবারিক সমস্যার কারণে ৮৭ শতাংশ, ভাঙা পরিবারের কারণে ৯৫ শতাংশ, খারাপ সঙ্গের কারণে ৭৯ শতাংশ, পর্নোগ্রাফি ও অ্যাকশন মুভি দেখার কারণে ৯৭ শতাংশ এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে শিশুরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বলে মনে করেন ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা।

গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মাদক ব্যবসার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অধিকাংশ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে তাদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে কিশোর গ্যাংগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রায়ই ঘটছে গোলাগুলির ঘটনা, বাড়ছে হত্যাকাণ্ড। তবে এসব অপরাধের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জমি দখল, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি বিভিন্ন থানায় মাদক ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের পৃথক তালিকায় এমন অনেক কিশোর অপরাধীর নাম উঠে এসেছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পল্লবী থানায় মাদক বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসীর পৃথক তালিকায় অন্তত দুই ডজন কিশোর অপরাধীর নাম ওঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে মিরপুর ১১ নম্বর বাউনিয়া বাঁধ ও এর আশপাশের এলাকায় মাদক ব্যবসার অন্যতম হোতা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মুসা (২১)। সে নিজে আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী, তেজগাঁও ও কারওয়ান বাজার থেকে মাদক এনে ব্যবসা করে। কিশোর অপরাধীদের মধ্যে অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী সরদার সামিউল ইসলাম সামি (২০) ও অনিক ওরফে নাইক্কা অনিক (২২)। তারা প্রত্যেকেই এক থেকে একাধিক মামলার আসামি। এ ছাড়া অস্ত্রধারী কিশোর অপরাধীদের মধ্যে অন্যতম মো. অনিক ইসলাম (২১)। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় আট মামলা ও একটির ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি আশিকুল ইসলাম শান্ত (১৯)।

এশিয়ান জার্নাল অব সোশিয়লজিক্যাল রিসার্চে ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘প্রসেস অব ক্রিমিনালাইজিং স্ট্রিট চিল্ড্রেন ইন বাংলাদেশ; এন এমপায়রিকাল স্টাডি ইন দ্য সিটি অব ঢাকা’ গবেষণায় বলা হয়, অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের ৯০.৫ শতাংশই মাদক ব্যবসা এবং ৩০.১ শতাংশ হত্যার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ছিনতাইয়ে জড়িত ৬৬ শতাংশ ও চুরির সঙ্গে জড়িত শতভাগ শিশু।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, মাদক ব্যবসার স্পট পরিচালনাসহ খুচরা পর্যায়ে মাদক বিক্রিতে শিশুদের সংখ্যাই বেশি। রাতের পাশাপাশি প্রকাশ্যে দিনের বেলা বিভিন্ন অলিগলিসহ মূল সড়কের পাশে দাঁড়িয়েও তারা মাদক বিক্রি করছে। ইশারায় ক্রেতা ডাকা, পকেট থেকে চাহিদামতো মাদক দেওয়া যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রকাশ্যেই চলছে তাদের এমন কেনা-বেচার দৃশ্য। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর ১০ নম্বরে থার্টিনাস ক্যাম্প, মিরপুর ১১ নম্বরে মিল্লাত ক্যাম্প, পল্লবীতে ভাসানটেক বস্তি, বালুরমাঠ বস্তি ও কুর্মিটোলা বস্তিতে এমন চিত্র দেখা যায়। ক্যাম্প ও বস্তির অলিগলি ছাড়িয়ে মূল সড়কের পাশেও তাদের মাদক বিক্রির এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। মাদক ব্যবসার ক্ষেত্রে তাদের ঢাল বানানোর বিষয়টি সত্যি। কারণ কিশোররা পুলিশের সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই আসবে না। এটি একটি বড় বিষয়। তা ছাড়া আমাদের দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি আছে, প্রভাবশালীদের কারণে আদালতে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি জানান, বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হলো পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। এ সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এর মধ্যে এক কোটির অধিক কিশোর-কিশোরী দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। তারাই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, তাদের কেউ নিজেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, কাউকে আবার অপরাধীচক্র ব্যবহার করে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার বা উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠালেই সব সমাধান হবে না। এ জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। রাতারাতি এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব না।

মন্তব্য করুন


Link copied