নিউজ ডেস্ক: তার নাম আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী। সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার সদস্য না হলেও মর্যাদার দিক দিয়ে তিনি ‘দৈবে দশম রত্ন’সদৃশ হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে ফৈজী, আবুল ফজল ও বীরবলের পরেই তার নাম উচ্চারিত হতো। শাহানশাহ আকবরের তিনি অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন। শাহানশাহ তাকে প্রায় কোনো সময়েই কাছছাড়া করতেন না; এমনকি প্রমোদভ্রমণের সময়ে কিংবা শিকারকালেও তিনি তাকে সঙ্গে নিতেন। আবুল ফজল তার বিখ্যাত ‘আকবরনামা’ গ্রন্থে তার অসাধারণ বিদ্যাবত্তা, সাহস ও কর্মকুশলতার প্রশংসা করেছেন। এক স্থানে তিনি এমনও বলেছেন যে, যদি দেশের সব প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনাদি বিলুপ্তও হয়, আমির তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম। তার উস্তাদ ছিলেন খাজা জামাল উদ্দীন মাহমুদ, কামালউদ্দীন শিরওয়ানী ও মীর গিয়াস উদ্দীন মনসুর শিরাজী। প্রথম জীবনে তিনি বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহের দরবার অলংকৃত করেন। ৯৯২ হিজরিতে (১৫৮৪ খ্রি.) সুলতানের ইন্তেকালের পর তিনি সম্রাট আকবরের নিয়োগ পেয়ে দিল্লির দরবারে আসন গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে রাজা তোডরমলের অর্থনৈতিক সহকারী হিসাবে নিযুক্ত হন। অর্থনীতিবিষয়ক গ্রন্থ রচনায় তিনি তাকে বিশেষ সহায়তা করেন। পরে ওই বিভাগে ‘সদর’ বা অধ্যক্ষের পদে উন্নীত হন এবং তিন বছর বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে কর্ম পরিচালনার পর ‘আমিন উল-মুলুক’ উপাধিতে ভূষিত হন। অতঃপর ‘আজাদ-উদ-দৌলা’ উপাধিতেও ভূষিত হন। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো বাংলা, ইলাহি ইত্যাদি সনের উদ্ভাবন। ‘মীরাতুল আলম’ গ্রন্থে তাঁকে বিশেষ প্রজ্ঞাসম্পন্ন মনীষী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি একজন সুদক্ষ শিকারিও ছিলেন। ‘আমীর-উল-উমারা’ গ্রন্থে তাকে ‘ছে হাযারী’ বা তিন হাযারী সেনাপতিও বলা হয়েছে। তার বিশেষ বীরত্বেরও খ্যাতি ছিল। বীরত্বের জন্য তার উপাধিও ছিল ‘রোস্তম সানী’ বা দ্বিতীয় রোস্তম।
৯৯৭ হিজরীতে (১৫৮৯ খ্রি.) তিনি খান্দেশ প্রদেশে ভ্রমণে যান। ফিরে এসে বিশেষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কথিত আছে, দরবারের বিশিষ্ট হেকিম আলী তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা দেন; কিন্তু তিনি অগ্রাহ্য করে ‘হরিসা’ নামে বিশেষ কোনো বস্তু গ্রহণ করেন এবং তারই ফলে তার মৃত্যু ঘটে।
‘তখতে সুলায়মানী’ নামক স্থানে তার মাজার অবস্থিত রয়েছে। তার মৃত্যুতে তার বিখ্যাত সহকর্মী ও মনীষী ফৈজী একটি স্মরণীয় কবিতা লিখেছিলেন।
আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী সম্পর্কে একটি কথা বিশেষভাবে বলা যায় যে, তিনি নিতান্ত সাধারণ মানুষ ছিলেন। ভবিষ্যতে বড় হওয়া বা অমর হওয়ার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষাও তার বিশেষ ছিল না। কিন্তু বড় তিনি হয়েছিলেন। বিজাপুরের মতো একটি ছোট রাজদরবারে থেকেও শাহানশাহ আকবরের মতো সম্রাটের শুভদৃষ্টি তিনি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবুল ফজল, ফৈজী, বীরবলের মতো বন্ধু লাভ করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, নবরত্ন সভার সদস্য না হয়েও তিনি তাদের সবারই শ্রদ্ধাভাজন হতে পেরেছিলেন। আজ বাংলা সনের জনকরূপে বাংলাদেশবাসীরও পরম আপনজনরূপে স্মরণীয় হয়ে রইলেন।
ধারণা করা হয়, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা নামটি আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর স্মৃতি ধারণ করে, কালের কটাক্ষ উপেক্ষা করে আজও টিকে আছে।
লোকশ্রুতি, সিরাজী তার কর্মের অবসানে বাংলা ছেড়ে আর যেতে চাননি। তিনি নারায়ণগঞ্জের নিকটবর্তী একটি স্থানে বসবাস শুরু করেন। পরে স্থানটি ফতেহউল্লাহ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, যা এখন ‘ফতুল্লা’য় পর্যবসিত হয়েছে। এখানে যে মাজারটি আছে, তাও আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী বলে কথিত। তবে ভিন্নমতও আছে।