মমিনুল ইসলাম রিপন: স্থানীয় সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, সমন্বয়হীনতা ও নাগরিক সচেতনতার অভাবে রংপুরের ফুসফুসখ্যাত শ্যামাসুন্দরী খালটি এখন মৃত্য শয্যাশায়ী। দখল আর দূষণের সঙ্গে সঙ্গে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে শতবর্ষী এ খালটি। নানা সময় শ্যামাসুন্দরী সংস্কারে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। যদিও নতুন করে আরও ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
তবে নদী গবেষক ও সংগঠকরা বলছেন, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া কোনো প্রকল্পই কাজে আসবে না। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচাতে আগে খালটি পুনরুদ্ধার করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন ও সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নয়তো ভবিষ্যতে খালটির অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার সঙ্গে তীব্র জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়বে নগরবাসী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পানির প্রবাহ না থাকায় দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি মশা-মাছির উপদ্রব বেড়েছে খালপাড়ে। এ ছাড়া অনেকে পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ এ খালে দেওয়ায় পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না করায় শ্যামাসুন্দরী খালটি নাব্যতা হারিয়েছে। এর দুই পাশ অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে খালটি। বর্তমানে শ্যামাসুন্দরীর কোলঘেঁষে এত অসহ্য দুর্গন্ধ যে এর পাশে মানুষ বাস করতে পারছে না।
এসবের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। নগরীর হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন শিপন বলেন, ২০১৯ সালে শ্যামাসুন্দরী খালের উন্নয়নের জন্য আমরা বাড়ি ভেঙে জায়গা ছেড়েছি। খালের পাড় থেকে গাছপালা কেটে ফেলেছি। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও খালের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং আগের চেয়ে এখন অবস্থা বেশি নাজুক। ময়লা-আবর্জনার কারণে ঠিকমতো পানি প্রবাহিত হয় না। দুর্গন্ধ আর মশার উৎপাতে আমাদের ভোগান্তি বেড়েছে।
নিউ সেনপাড়া করণজাই রোড এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান সেলিম বলেন, নির্বাচন আসলে শুনতাম শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কার করা হবে। এরপর নির্বাচন শেষ খাল নিয়ে ভোটের রাজনীতিও শেষ। আমরা শুধু শুনেই আসছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সংস্কার চোখে পড়লো না। যত দিন যাচ্ছে খালের দুইপাড়ে প্রভাবশালীরা দখল করে নানা স্থাপনা তৈরি করেছে। গত আট মাস ধরে পরিষ্কার না করায় পুরো খালটি ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে।
কেরানিপাড়ার বাসিন্দা সোহেল রানা ও কামারপাড়া এলাকার রাসেল হোসেন জানান, শ্যামাসুন্দরী খাল তাদের কাছে গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। অথচ তিন-চার দশক আগেও শ্যামাসুন্দরীর নামের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যেতো। এখন এই খাল ধুঁকে ধুঁকে মরছে। একের পর এক জনপ্রতিনিধি এলো, কতজন কতরকম আশ্বাস দিয়ে গেলো কেউ শ্যামাসুন্দরী আজো সুস্থ হয়ে উঠেনি।
কামাল কাছনা এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান খোকন বলেন, আগে বৃষ্টি হলে শহরের সব পানি শ্যামাসুন্দরী খালে গিয়ে পড়ত। বতর্মানে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন অনেকটা বাধার সম্মুখীন। এ কারণে নগরীতে ভারী বৃষ্টিপাত হলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
এদিকে দীর্ঘদিনেও শ্যামাসুন্দরী রক্ষা ও সংস্কারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় নগরবাসীর বাড়ছে ক্ষোভ। পৌরসভা থেকে রংপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার প্রায় দেড় দশক সময় পেরিয়ে গেলেও শ্যামাসুন্দরী খাল এখন জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের স্বচ্ছ পানির এ খাল এখন দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর। মশা-মাছি আর পোকা-মাকড়ের প্রজননক্ষেত্রই শুধু নয়, দখল-দূষণেও এই খাল পরিবেশের জন্য এখন মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে দুটি প্রকল্পসহ বিভিন্ন ভাবে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় শ্যামাসুন্দরীর সংস্কারে। অথচ এর সুফল পাননি নগরবাসী। সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সময়ে বলা হয়েছিল নতুন করে আরও ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রণয়ণের কাজ চলমান রয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন হলে প্রাণ ফিরবে শ্যামাসুন্দরীর।
রংপুর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, খালটি জেলা প্রশাসনের আমরা শুধু পরিস্কার করে থাকি। কিন্তু এরজন্য বরাদ্দ খুব একটা থাকে না। শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কারে টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প প্রয়োজন। তা না হলে ছোট ছোট প্রকল্প দিয়ে এটির সুরক্ষা সম্ভব হবে না। বর্তমানে রংপুর শহরের আকাশ খারাপ হলে গোটা নগরী পানিতে ডুবে যাবে, যা কয়েক বছর আগে আমরা বুঝতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা কিন্তু পরপর দুইবার পানিতে ডুবে ছিলাম। ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ১১ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রংপুর নগরীর প্রধান সড়ক, পাড়া-মহল্লার অলিগলিসহ বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মালামাল, খাদ্যশস্যসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্থানীয়রা ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদি পশুসহ আশ্রয় নেয় নগরীর স্কুলগুলোতে। এরপরেও খাল নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেউ। পরের বছর ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় ২৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে আবারো ডুবে যায় শ্যামাসুন্দরী নির্ভর রংপুর নগরী।
এদিকে নতুন করে খালটির সংস্কারে ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যেখানে শ্যামাসুন্দরী সংস্কারের পাশাপাশি দুপাশে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান বলেন, প্রথমিকভাবে শ্যামা সুন্দরী পরিষ্কারের পাশাপাশি দুপাশে গাছ লাগানো হবে। এরপর স্টাডি করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে শ্যামা সুন্দরীর স্থায়ী সমাধানে কাজ করা হবে।
তবে রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, শ্যামাসুন্দরী নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ না নেয়া গেলে এ প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না।শ্যামাসুন্দরীর সংস্কার একা জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে সম্ভব না। এ কাজের জন্য সমন্বিত প্রকল্প নিতে হবে। যেখানে পরিবেশ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, এলজিইডিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মিলে একটা প্রকল্প নিতে হবে। তবেই কেবল শ্যামাসুন্দরী রক্ষা পেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ঘাঘটের উৎসমুখ তিস্তা নদী থেকে শ্যামাসুন্দরীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে শ্যামাসুন্দরী তার নিজস্ব স্রোত হারিয়েছে। এই খালের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এখন জরুরি। এজন্য শ্যামাসুন্দরী বাঁচাতে ঘাঘটের উৎসমুখ খুলে দেওয়া, শ্যামাসুন্দরী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা, দূষণ বন্ধ করা ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করার দাবি জানান তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, পরিকল্পনা মাফিক কোনো উন্নয়নকাজ না হওয়ায় শ্যামাসুন্দরী খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের ৬০ ফুট চওড়া খালটি বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ ফুটে এসে ঠেকেছে। এ খালটির সংস্কার ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে ২০১৯ সালে ৫১১ জন দখলদার চিহ্নিত করা হলেও পরবর্তীতে তা কীভাবে ১১৭ জনে দাঁড়াল, তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, জলাবদ্ধতা দূর ও ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রংপুরকে মুক্ত রাখতে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকী বল্লভ সেন ১৮৯০ সালে তার মা চৌধুরানী শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে খালটি পুনঃখনন করেন। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের সম্মুখে রয়েছে নগরীর কেলাবন্দের ঘাঘট নদ।
সেখান থেকে শুরু করে নগরীর ধাপ পাশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সীপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, মুলাটোল, তেঁতুলতলা শাপলা সেতু, নূরপুর, বৈরাগীপাড়া হয়ে মাহিগঞ্জের মরা ঘাঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এলাকাভেদে এর প্রস্থ ২৩ থেকে ৯০ ফুট ছিল। বর্তমানে শ্যামাসুন্দরী দখল-দূষেণের কারণে মৃতপ্রায়।