নিউজ ডেস্ক: চরম উত্তেজনার মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। উভয় পক্ষই সীমান্তে জড়ো করছে সেনা, ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমান। উত্তেজনার মধ্যেই গতকাল ভারতীয় নৌবাহিনী মিসাইল ধ্বংসের পরীক্ষা চালিয়েছে। এদিকে বুধবার ভারতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে গতকাল পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণায় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ভারতের জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমাও বন্ধ থাকার কথাও বলা হয়েছে। সূত্র : বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, আনন্দবাজার পত্রিকা, এনডিটিভি, ডন, ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়ার পর গতকাল বিকালে পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠক থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বন্ধ করা হলো। ভারতীয় বিমানগুলোকে পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। সেই সঙ্গে ভারতীয়দের পাকিস্তানে যাওয়ার সব ভিসা বাতিল করা হলো। তবে শিখ পুণ্যার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দেবে পাক প্রশাসন। এনএসসি ভারতের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে জানায়, পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ ভারতে যদি একতরফাভাবে বন্ধ বা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়, তবে সেটিকে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। খবরে বলা হয়, ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া সব সার্ক ভিসা বাতিল করেছে পাকিস্তান। এই ভিসার আওতায় পাকিস্তানে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত দেশটির প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। অবিলম্বে তাঁদের পাকিস্তান ছাড়তে বলা হয়েছে। তাঁদের সহায়তায় নিযুক্ত কর্মীদেরও ভারতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মকর্তার সংখ্যা ৩০-এ নামিয়ে আনতে বলেছে পাকিস্তান। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তা করতে বলা হয়েছে। পাকিস্তান দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সব ধরনের বাণিজ্যও স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ।
এদিকে দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা গেছে, উভয়পক্ষই সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করছে। সীমান্ত বরাবর এরই মধ্যে অবস্থান নিয়েছে দুই দেশের বিপুল সংখ্যক সেনা, সাজোয়া ট্যাংক, বোমারু বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র। পাক বিমানবাহিনীর ভারত লাগোয়া ছাউনিগুলোর মধ্যে লাহোরসংলগ্ন মুরিদে মোতায়েন করা হয়েছে নজরদারি এবং হামলাকারী ড্রোন। কয়েক বছর আগে তুরস্ক থেকে যে বের্যাক্টার টিবি-২ নামের ড্রোন কেনে ইসলামাবাদ, সেগুলোর প্রায় সব কটিই ওই ঘাঁটিতে মোতায়েন করা হয়েছে। বিমানসেনা ঘাঁটির পাশাপাশি জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি) উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে পাক বাহিনী। সেখানকার বাঙ্কারগুলোতে সেনারা অবস্থান নিয়ে আছে।
ভারতীয় সূত্র দাবি করছে, সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় ইসলামাবাদের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধির প্রমাণ মিলেছে বিমান ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ‘ফ্লাইটরাডার২৪’-এর স্ক্রিনশট থেকে। এক্স হ্যান্ডলে সেগুলোকে ছড়িয়ে দেন নেটাগরিকদের একাংশ। ওই স্ক্রিনশট অনুযায়ী, পেহেলগাম কাণ্ডের পর দক্ষিণের করাচি বিমানসেনা ঘাঁটি থেকে একের পর এক বিমান উত্তরের লাহোর এবং রাওয়ালপিন্ডির কাছে মোতায়েন করেছে ইসলামাবাদ। পিএএফ১৯৮ এবং লকহিড সি-১৩০ই হারকিউলিস নামের পরিবহন বিমান দক্ষিণের ঘাঁটি থেকে উত্তরে নিয়ে গেছেন রাওয়ালপিন্ডি সেনা কর্মকর্তারা। এ ছাড়া পিএএফ১০১ ও এমব্রায়ের ফেনম ১০০ নামের ছোট জেট বিমানও সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে এমন উত্তেজনার মধ্যে গতকাল মিসাইল ধ্বংসের পরীক্ষা চালিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে এক পোস্টে নৌবাহিনী জানিয়েছে, তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি মিসাইল বিধ্বংসকারী আইএনএস সুরাত সফলভাবে সামুদ্রিক অঞ্চলে একটি দ্রুত, নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া মিসাইল ধ্বংস করেছে। এর মাধ্যমে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি মাইলস্টোন অর্জিত হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানিয়েছে, পাকিস্তানের নৌ কর্মকর্তারা করাচি উপকূলে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সারফেস টু সারফেস মিসাইলের পরীক্ষা চালাচ্ছে, যার জবাবে এই পরীক্ষা চালানো হলো।
আরেক খবরে বলা হয়েছে, ভারত কোনোভাবেই কাশ্মীরের পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের হত্যাকারী এবং এই হামলার নেপথ্যে যারা রয়েছে তাদের ছাড় দেবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল বিহারের এক সভায় তিনি আরও বলেছেন, পাকিস্তানি এসব হামলাকারীর এমন সাজা দেওয়া হবে যা কল্পনারও অতীত। মোদি বলেন, বিহারের মাটি থেকে আমি পুরো বিশ্বকে বলছি- ভারত প্রত্যেক সন্ত্রাসীকে এবং তাদের যারা সমর্থন করছে, তাদের চিহ্নিত করবে এবং সাজা দেবে। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে হলেও তাদের খুঁজে বের করা হবে।
কাশ্মীরজুড়ে আটক দেড় হাজারের বেশি : বুধবার থেকে গতকাল পর্যন্ত জঙ্গি ধরতে কাশ্মীরজুড়ে চিরুনি অভিযান চালিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী দেড় হাজারেরও বেশিজনকে আটক করেছে। সেনা সূত্র জানিয়েছে, অভিযানের অংশ হিসেবে সকালে জম্মু ও কাশ্মীরের উধমপুর জেলার দুধু-বসন্তগড় এলাকায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলির সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্য নিহত হয়েছেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই অঞ্চলে সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। পাল্টা জবাব দেয় নিরাপত্তা বাহিনীও। গোলাগুলির মধ্যেই ছয় প্যারা স্পেশাল ফোর্সের জওয়ান হাবিলদার ঝন্টু আলী শেখ নিহত হন।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন : ইসলামাবাদের নিরাপত্তা বিশ্লেষক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী বলেছেন, ‘ভারত পাকিস্তানে হামলা চালাতে পারে এবং এটি ২০১৯-এর চেয়েও বড় পরিসরে হবে।’ তিনি দাবি করেন, ভারত এই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্মতা দেখানোর এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজনা কমানোর একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও, কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে।
ভারতীয় কংগ্রেস দলের বৈঠক : নয়াদিল্লি প্রতিনিধি জানান, কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় অমিত শাহ অধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা নিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছে জাতীয় কংগ্রেস। গতকাল কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকারজুন খাড়্গের সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কার্যকরী কমিটির বৈঠক বসে। এখানে সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান সোনিয়া গান্ধী, লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীসহ শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি ছিল। এক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, পহেলগামে ত্রিস্তরের নিরাপত্তা থাকে, যেটা ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। এই নিরাপত্তা কীভাবে বিঘ্নিত হলো এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। কংগ্রেস দল এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানকেই দায়ী করছে।