শেখ মাজেদুল হক
আজ ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর দিনটির প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি, ভোক্তার স্বার্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করি।’ ভোক্তা অধিকার একটি মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার। অথচ, পদে পদে ভোক্তাদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সঠিকভাবে মূল্য পরিশোধ করার পরও তাকে সঠিক পণ্য, সঠিক সেবা দেয়া হয় না। ভুক্তভোগীরা জানে না, তারা কীভাবে তাদের এ অধিকার আদায় করে নেবে। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের আইনে অজ্ঞতার কারণে আমাদের বাজারগুলোতে অশান্তি বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে ব্যাপক আইন সচেতনতার পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের অধিকার রক্ষা হবে।
১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন. এফ কেনেডীর উদ্যোগে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থে চারটি অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। এ চারটি অধিকার হলো : ১) পণ্য ও সেবা কিনে বা গ্রহণ করে নিরাপত্তা পাবার অধিকার; ২) পণ্য বা সেবা বিষয়ে ভোক্তার তথ্য জানার অধিকার; ৩) ন্যায্য মূল্যে পছন্দসই পণ্য বা সেবা ভোগের অধিকার এবং ৪) অভিযোগ করার এবং প্রতিনিধিত্বের অধিকার। মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ঐতিহাসিক দিনটি স্মরণে প্রতিবছর ১৫ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক ভোক্তা অধিকার দিবস। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরো বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরো আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করা হয়। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়।
একজন বিক্রেতার বা উৎপাদকের অধিকার রয়েছে উৎপাদিত পণ্য থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ লাভ করা। বিপরীতে একজন ভোক্তার অধিকার রয়েছে তার পরিশোধিত মূল্যের বিনিময়ে নির্ধারিত পণ্য পাওয়া।বাজার ব্যবস্থার প্রধান দুটি দিক হলো ক্রেতা ও বিক্রেতা। যদিও যিনি ক্রেতা তিনি ভোক্তা নাও হতে পারেন তবে ধরা হয় ভোগের উদ্দেশ্যেই তিনি ক্রয় করেন। অর্থাৎ তিনিই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে ক্রেতার যে অধিকারগুলো আছে বলে জানা দরকার তা আমাদের দেশে খুব কম মানুষই জানে। সেজন্যই একদিকে যেমন অসাধু ব্যবসায়ী লাভবান হয় তেমনি বাজার ব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়।একজন ক্রেতার সাথে ভোক্তার সম্পর্ক হবে আন্তরিক এবং বিশ্বস্ততা পূর্ণ । অর্থাৎ নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে ভোক্তা যে পণ্যটি কিনবে তা যেন কিনে যেন সে না প্রতারিত হয়। যদি এভাবে সম্পর্ক এগিয়ে যায় তাহলে উভয়ের ভেতর হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ ও তাদের অধিকার রক্ষায় একটি কার্যকর আইন প্রণয়নের দাবি ছিল দীর্ঘ দিনের। তারই প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯।ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে : (ক) কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা, (খ) জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা, (গ) মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা, (ঘ) কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা। (ঙ) প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা, (চ) কোনো পণ্য সরবরাহ বা বিক্রির সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপেক্ষা কম ওজনের পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করা, (ছ) কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া, (জ) কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পরিমাপ অপেক্ষা কম পরিমাপের পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করা, (ঝ) কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া। (ঞ) কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, (ট) মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা এবং সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কাজ করা, যা কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।এরপরও আইনটি প্রণয়নের ফলে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ভোক্তা তথা জনগণ এর সুফল পেতে শুরু করেছে।আগে যেখানে অসাধু ব্যবসায়িরা প্রকাশ্যেই পণ্যে ভেজাল মেশাতেন, আজ সেখানে কিছুটা হলেও রাগঢাক করা হচ্ছে।
একুশ শতকের উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার যুগে নিরাপদ, মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য ও সেবা পাওয়া প্রত্যেক ভোক্তার অধিকার। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও ক্রমবিকাশমান বাজার ব্যবস্থাপনার দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ রোধ করা খুবই জরুরি। দেশের ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেশের ১৬ কোটি ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল খুবই নগণ্য। জনবল সংকট থাকায় প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিংসহ ভোক্তা স্বার্থরক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা অধিদপ্তরের পক্ষে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। আইনে দেশের প্রচলিত পণ্যের গ্রাহকদের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের গ্রাহকদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। সম্প্রতি বিভিন্ন ইকমার্স প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি, ডিজিটাল আর্থিক খাতে প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণা, অনলাইনে অবৈধভাবে ঋণদানের নামে প্রতারণা, ইটিকেটিংয়ের ক্ষেত্রে মনগড়া সার্ভিস চার্জ আদায় এরই প্রমাণ। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিভিন্ন উদ্যোগ ও ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি দেশের ডিজিটাল মাধ্যমে একটি বিশাল ভোক্তাগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় ইকমার্স সেবা, অনলাইন রাইড শেয়ারিং, অনলাইন ফুড ডেলিভারি সিস্টেম, ইটিকেটিং, বিভিন্ন সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট ও অ্যাপের ক্রেতা, অনলাইনে বিভিন্ন সেবার গ্রাহক, মোবাইল ব্যাংকিং খাতের গ্রাহক ও টেলিকম সেক্টরের ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আইনের মাধ্যমে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।ভোক্তা অধিকার উন্নত দেশে বহুদূর এগিয়েছে। উন্নত দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে কঠোর অবস্থান রয়েছে। আমি, আপনি আমাদের সন্তান সবাই একজন ভোক্তা। প্রত্যেকের নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়ার অধিকার রয়েছে। কেউ সেবার নামে প্রতারণার আশ্রয় নিলে অভিযোগ করার আইনগত অধিকার আমাদের রয়েছে। আমরা যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে ভোক্তা অধিকার বিষয়টি থেকে যাবে অন্তরালে। একটি দিবস আমাদের সাময়িকভাবে সেই দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরে। আমাদের উচিত সেই দিবসের গুরুত্ব বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। এর ফলে ভোক্তারা পণ্য ক্রয়ে প্রতারিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। একজন বিক্রেতার বা উৎপাদকের অধিকার রয়েছে উৎপাদিত পণ্য থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ লাভ করা। বিপরীতে একজন ভোক্তার অধিকার রয়েছে তার পরিশোধিত মূল্যের বিনিময়ে নির্ধারিত পণ্য পাওয়া। আমরা যদি প্রাপ্য অধিকারের বিষয়ে সরব না হই অসাধুরা প্রতারণা চালিয়েই যাবেন।
একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। এর কিছু প্রদান করে থাকে পরিবার, কিছু করে রাষ্ট্র। তবে অন্যান্য অধিকার থেকে ভোক্তা অধিকার কিছুটা ভিন্ন। যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন কেবল নিজে ভোগ করার জন্য; তিনিই ভোক্তা। একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি। এগুলো হল- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার।
পণ্য ক্রয়ে প্রতারণার হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে বহুল প্রতীক্ষিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনের ফলে কোনো ভোক্তা পণ্য ক্রয়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, মূল্যসহ কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পেয়ে থাকেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি সম্পর্কে অবগত নয়। এমনকি শিক্ষিত সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যেও এই আইন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। এই আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার দরুন প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে পণ্যের যে মান উল্লেখ থাকে, মূল্য পরিশোধের পর পণ্য হাতে পেয়ে দেখা যায়- বর্ণিত গুণাগুণ সেই পণ্যের মধ্যে নেই। তাই ভোক্তাকে এই আইন সম্পর্কে জানতে হবে এবং নির্ধারিত পন্থায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। তাহলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও কমে আসবে।আর ২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এছাড়াও কয়েকটি ধারার উপধারা রয়েছে। আমি ভোক্তা অধিকার আইনের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। ৩৭ ধারা মোতাবেক পণ্যের মোড়ক না থাকলে বা মোড়কে পণ্যের তথ্য না থাকলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৩৮ ধারায় পণ্যের দাম সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। ৩৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে, সেবার দাম সংরক্ষণ এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।৪০ ধারা অনুযায়ী, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, সেবা বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪১ ধারা অনুযায়ী ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪২ ধারা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪৩ ধারায় উল্লেখ আছে, জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য অবৈধ উপায়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪৪ ধারায় উল্লেখ আছে, পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন ইত্যাদি।
পণ্য কিনে প্রতারিত হলে অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি খুবই সহজ। বর্তমানে প্রত্যেকের হাতে হাতে স্মার্টফোন। গুগোল প্লে-স্টোরে সংরক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ’ অ্যাপসের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায়।আর ২০০৯ সালের আইনটি হওয়ার আগে কমবেশি ৪০ টি আইন ও ধারা বিচ্ছিন্নভাবে ভোক্তা অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। ২০০৯ সালের আইনের মাধ্যমে সবগুলো প্রাসঙ্গিক বিষয় একসাথে করা হয়।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে আরো যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইন আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিএসটিআই অধ্যাদেশ ১৯৮৫, অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রী আইন ১৯৫৬, নিরাপদ খাদ্য আইন ১৯৫৯, পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০, ওজন ও পরিমাপ আইন ১৯৮২ ও এক্রেডিটেশন বোর্ড আইন ২০০৬। সবগুলো আইনেই ভোক্তা অধিকারের কথা বলা আছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। তারা বহুদিন থেকেই এধরনের আইন বাস্তবায়নের সুফল পেয়ে আসছে। নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়ে থাকে। একটি কার্যকর ভোক্তা আইনের ফলে সেসব দেশে জনস্বার্থ তথা ভোক্তা অধিকার আজ একটি প্রতিষ্ঠত বিষয়।
ব্যবসা-বাণিজ্য তথা ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা দাম দিয়ে ভেজাল পণ্য ও সেবা ক্রয় করি। এ নিয়ে নাগরিকরা কোনো প্রতিবাদ করে না। রাষ্ট্রও নির্বিকার। কিন্তু অন্যান্য দেশে ভোক্তা অধিকার লংঘনের কথা ভাবাও যায় না। ভোক্তা অধিকার লংঘন করলে অনেক দেশে বিক্রেতার লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়। শুধু তাই নিয়, আছে ফৌজদারি দণ্ডও। তাই আইনের বাস্তবায়নটাই বড় কথা।
যেকোনো দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু আমাদের মাঝে অর্থাৎ ভোক্তাদের মাঝেই সে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে, ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে।
মিথ্যাচার, ভেজাল, ফর্মালিন আজ ভোগ্যপণের সাথে মিশে গেছে। এমনকি ওষুধ দিয়ে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। বাজারের শাক-সবজি, ফল-মূল সব কিছুতেই ফরমালিন।
অনলাইন কেনাকাটা বা আর্থিক লেনদেন যেন স্বচ্ছ হয়, এখানে যেন কোনো ধরনের প্রতারণা বা অনিয়ম না হয় এবং গ্রাহকরা যেন তাদের ন্যায্য অধিকার পান, সে বিষয়ে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা প্রত্যেকেই নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি দায়িত্বশীল হতে হবে। রোজার মাসে ভোক্তা সাধারণ যাতে কারো ব্যক্তিস্বার্থ বা লোভ-লালসার কারণে কষ্ট না পায় সেদিকে ব্যবসায়ী, জনগণ ও জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সরকার শিক্ষা খাতসহ অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তৈরি ও ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস এবং বিগ-ডাটা সমন্বিত ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগ সরকার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন এখন অনেক কিছুই ডিজিটাল বা অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে এবং প্রতিদিন এ খাতে ভোক্তাদের ঝুঁকির নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। তাই অনলাইন কেনাকাটা বা আর্থিক লেনদেন যেন স্বচ্ছ হয়, এখানে যেন কোনো ধরনের প্রতারণা বা অনিয়ম না হয় এবং গ্রাহকরা যেন তাদের ন্যায্য অধিকার পান, সে বিষয়ে সকল ব্যবসায়ী ও ভোক্তা প্রত্যেকেই নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি দায়িত্বশীল হতে হবে ।
যখন আমরা একটা পণ্য কিনতে যাই পণ্যের গায়ে লিখা মূল্য ১৫ টাকা, আমাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে ২০ টাকা কিন্তু আইনে লেখা আছে ১৫ টাকার বেশি বিক্রি করা যাবে না, ১৫ টাকার নিচে বিক্রি করতে পারবে। দামের দিক দিয়ে, মানের দিক দিয়ে, ওজনের দিক দিয়ে যে অনিশ্চয়তা, ভেজালে ভরা আমাদের বাজারের পণ্য গুলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর হয়েছে কিন্তু এখনো আমরা ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। পৃথিবীর মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রমজান উপলক্ষে পণ্যের বাজার মূল্য কমানো হয়, কিন্তু আমাদের দেশ বিপরীত আমাদের দেশে রমজান উপলক্ষে পণ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় শাকসবজি, ফলমূল, এবং মনিহারি দোকান গুলোতে। আসুন আমাদের দেশকে ভালোবাসি, ক্রেতাদের কে ভালোবাসি, আসুন আমরা সৎ ব্যবসায়ীর অন্তর্ভুক্ত হই ।
ভোক্তাই প্রথম, ভোক্তারাই সর্বে সর্বা । ভোক্তারাই সব শক্তির উৎস। আমরা ভেজাল পণ্য না কিনলে উৎপাদনকারী কোম্পানি যত বড়ই হোক না কেন একদিন তাকে পথে বসতেই হবে। আসুন, আমরা ভোক্তার অধিকার বিষয়ে সচেতন হই, ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। সেই সাথে ভেজালের বিরুদ্ধে সচেতন ও সোচ্চার হই।বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা হবে।
লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর email: smh.mkt@brur@ac.bd