ডেস্ক: অবশেষে আলোর মুখ দেখছে তিস্তা প্রকল্প। ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে চীন। কারিগরি কমিটির পর্যালোচনা শেষে এ সংক্রান্ত ফাইল এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলেই তিস্তা নদীর পাড়ে শুরু হবে প্রকল্পের কাজ। চীনা অর্থায়নে এ মেগাপ্রকল্পের কাজ তিন ধাপে শুরু হবে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শুধু নদীই নয়, বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা।
এ অবস্থায় গত রবিবার তিস্তা ব্যারাজ এলাকা পরিদর্শন করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংসহ তিন সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের দল। পরিদর্শনকালে লি জিমিং উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় জনগণের চাহিদা এবং কিসে তাদের ভালো হয়, সেটি জানা দরকার। সেটিই আমাদের বা চীনের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে বিআরআই (চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) একটি বড় প্রকল্প। আমাদের সব অংশীদারের কাছ থেকে সব ধরনের অংশগ্রহণ দরকার। তিস্তা একটি বৃহৎ নদী, এটি খনন করতে পারলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন হবে। এটি বাংলাদেশে আমার প্রথম কাজ। যদিও এ প্রকল্প বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের, এর পরও এটি করব।’ নদীটি খননের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অংশ হিসেবেই তাদের এ দুদিনের সফর বলে জানান চীনা রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রকৌশলীরা বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর আমরা পরিকল্পনা করব কবে থেকে কাজটি শুরু করা যায়। তবে আশা করছি শিগগির তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করতে পারব। এটি শুধু এ অঞ্চলের মানুষের জন্য সুসংবাদ নয়, পুরো বাংলাদেশিদের জন্যও গর্বের বিষয়।’
শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট দূর করা, তীর ব্যবস্থাপনা, বন্যানিয়ন্ত্রণে তিস্তা নদী ঘিরে সরকারের নেওয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি বলেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। এখানকার মানুষ, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশ, লোকজনের চিন্তা-ভাবনা, মানসিকতা তিস্তা মহাপরিকল্পনার পক্ষেই। তাই আমরা এ মহাপরিকল্পনাটির পুরো বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করব।’
তিস্তা প্রকল্পের ব্যাপারে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, চীনের সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে নদীটির বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুজ্জীবনে একটি প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে আছে বিষয়টি। উনার সম্মতি পেলেই কাজ শুরুর সম্ভাবনা আছে।
জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার চারদিকে ধু-ধু বালুচর ভেসে ওঠে। অন্যদিকে ভরা বর্ষায় বন্যা আর নদীভাঙন। ভারত হয়ে আসা এ নদীর পানির ন্যায্য ভাগ আদায়ে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেনদরবার করে হতাশ বাংলাদেশ। ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্বে সংকটের সমাধান না পেয়ে এখন বিকল্প পথে ঢাকা। তিস্তা রক্ষায় ২০১৬ সালে বেইজিংয়ের কাছে এক বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের প্রস্তাব দেয় ঢাকা। নদীটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধারে ৭২৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে চালায় সমীক্ষা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে চীনের হোয়াং হো নদী ও সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়কে আধুনিকভাবে গড়ে তোলা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এ ছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদীপাড়ের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। সেই সঙ্গে তৈরি হবে ১৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানা ও ইপিজেড।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদী ড্রেজিং করে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুই পাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ এবং বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার করা হবে। এতে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতিবছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা।
চীনের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশের অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। বন্যার কারণে ভাসাবে না গ্রামগঞ্জ ও জনপদ। সারা বছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নৌবন্দর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। খবর- দৈনিক আমাদের সময়