শেখ মাজেদুল হক
১৯৭২সালের ১০ই জানুয়ারী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন কারণ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘ সময় বন্দী থাকার পর দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বিশ্বের মানচিত্রে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে বঙ্গবন্ধুর অবদান সবচাইতে বেশি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা বঙ্গবন্ধুর চোখে সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকেই তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। পাকিস্তানি দের কাছে ন্যায্য হিস্যার জন্য দেশে এবং বিদেশে আন্দোলন সংগ্রামের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষণ বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি তার দেশবাসীকে পাকিস্তানি জান্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে নানান ভাবে উদ্বুদ্ধ করেন।
নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর হাজার ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হলো। বাঙালি স্বাধীনতা লাভ করল। কিন্তু এদেশের সাত কোটি বাঙালি কারো মনেই শান্তি এবং স্বস্তি রইল না ।কারণ তাদের নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু জাতির জনক তখনও পাকিস্তান কারাগারে বন্দি দশায়। সকলের একই আকুতি, একই প্রশ্ন কবে ফিরবে নেতা? নেতা কি আসতে পারবে স্বাধীন বাংলাদেশে? আকাশ- বাতাস মাঠ -নদী গ্রহ-নক্ষত্র বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার জন্য আকুল আহ্বান, আকুতি কবে আসবে নেতা? নেতার বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য নিস নিস ধর্ম অনুযায়ী সকলেই প্রার্থনা করতে শুরু করলো। গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই একই প্রশ্ন নেতা কবে আসছে? কখন আসছে? কিভাবে আসছে নেতাকে কখন দেখবো? অবশেষে ১৯৭২সালের ৮ ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হলো।
পাকিস্তান থেকে লন্ডন এবং ভারত হয়ে যখন বাংলাদেশের সীমানায় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান তেজগাঁও বিমান বন্দরে সেই মহানায়কের প্রত্যাবর্তন তখন পাইলট নিচে বিমান নামাতে সুযোগ পেল না ,কারণ এতটাই লোকে লোকারণ্য তখন বিমানসেবিকা বলল বঙ্গবন্ধুকে আপনাকে মানুষ কতটা ভালবাসে, শুধু মাত্র আপনার অপেক্ষাতে আজ দেখুন বিমানবন্দর জনসমুদ্র হয়ে গেছে। বিমানবন্দরে নেতা নামার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই আবেগাপ্লুত হয়ে অপরকে জড়িয়ে ধরল। নেতাকে দেখে সকলেই আনন্দ অশ্রু সিক্ত হলো। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হলো সারাদেশ আকাশ বাতাস। মাইকে প্রচারিত হলো -আমাদের প্রিয় নেতা আমাদের মাঝে এসে গেছে। স্লোগান উঠলো-আমার নেতা তোমার নেতা- শেখ মুজিব শেখ মুজিব। স্বাগতম হে জাতির পিতা ।তিনি ছিলেন আমাদের নেলসন ম্যান্ডেলা।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন দুর্দান্ত সংগঠক এবং পাকিস্তানি শাসনের কড়া সমালোচক।প্রতিবাদ করেছিলেন পরবর্তীকালে আইয়ুব খানের সামরিক একনায়কতন্ত্রের। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন। তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা পাকিস্তান সরকারকে আতঙ্কিত করেছিল এবং তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়েছিল।কিন্তু বাঙালিরা তার দেশপ্রেমের উপর প্রবল আস্থা রেখেছিল এবং তাকে অত্যন্ত ভালবাসত। প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরাসহ সর্বদলীয় ছাত্র ইউনিয়নও তাকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছিলেন।এরপর তীব্র আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানিরা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।তবে এরই মধ্যে আইয়ুব খান সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন।১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৬৭ টি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে,ফলশ্রুতিতে পুরো বিশ্ব বঙ্গবন্ধুকে অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক চক্র ক্ষমতা স্থানান্তর করতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের পিছনে ছিল ষড়যন্ত্রকারী জুলফিকার আলী ভুট্টো। একাত্তরের ২৫ শে মার্চ রাতে হাজার হাজার নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল। রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র এমনকি পথচারীকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্রস্তুত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
একাত্তরের ১৬ ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।এই সময় বঙ্গবন্ধু বন্দী অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু বিশ্ব জনমত এবং তার উদার চিন্তাচেতনায় পাকিস্তানিরা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।
মহান নেতা প্রথমে লন্ডনে গিয়েছিলেন যেখানে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাকে স্বাগত জানান। তারপরে তিনি নয়াদিল্লিতে চলে গেলেন, যেখানে তিনি তার পাশে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বিমানবন্দরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন।
জননন্দিত শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তার ঐতিহাসিক ধ্রুপদী বক্তৃতায় বলেন, যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সদ্যস্বাধীন বাঙালি জাতির কাছে ছিল একটি বড় প্রেরণা। তার এই প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে”। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি তাকে মুক্ত করার জন্য তাঁর লোককে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন যে আমরা শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন জাতি। একজন ব্যক্তি, বাঙালি এবং মুসলমান কেবল একবার মারা যায়, তিনি মন্তব্য করেছিলেন। মৃত্যুর কোনও ভয় তাঁর ছিল না। এরপর তিনি তার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা শুরু করেন।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সর্বস্তরের মানুষেরা কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন এবং স্বাধীনতার জন্য বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিল। আমরা বাঙালিরা পুরো বিশ্বকে প্রমাণ করে দিয়েছিলাম যে আমরা একজন বীরের জাতি এবং যে নেতা আমাদের আত্মবিশ্বাসী ও ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ নন। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বড় হলেও আমরা একটি মুক্ত জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়েছি। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আর উপনৈবেশিক নাগরিক হবে না।
তিনি সেই নিঃস্বার্থ নেতা, যিনি তাঁর বাঙালি ভাই-বোনদের জন্য একটি স্বাধীন দেশের জন্য পুরো জীবন লড়াই করেছিলেন।পদ্মা,যমুনা ও মেঘনা যতদিন প্রবাহমান থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুকে সমগ্র বিশ্ব স্মরণে রাখবে। বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি উনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে অতল বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ; বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।