নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কওমী উদ্যোক্তাদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এক নারী সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রবেশ করতে না দেওয়ার ঘটনায় ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা চলছে এবং পরবর্তীতে কওমী উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ 'কওমী উদ্যোক্তা'র মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করে একটি সংবাদ বিবৃতি দেওয়া হয়।
ঘটনাটি ঘটে গত বুধবার ঢাকার চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে 'কওমী উদ্যোক্তা সম্মেলন ২০২৫' নামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে, যার প্রধান অতিথি ছিলেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। অনুষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহের জন্য যান ইউএনবির সাংবাদিক এমি জান্নাত।
ইউএনবির সাংবাদিক এমি জান্নাত জানান, অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে বুধবার বিকেল তিনটায় চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে যান। তিনি বলেন, "গেট দিয়ে ঢোকার সময় গার্ডরা বলে- আপনি তো ঢুকতে পারবেন না। কওমী, উনাদের প্রোগাম। উনারা মানা করছে। ভলান্টিয়ার আছে। তাদের সাথে কথা বলেন ওরা যেতে দেয় কিনা।"
অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে চেয়ে আরও ২০ মিনিট অপেক্ষার পর নিরাপত্তা প্রহরীরা ভেতর থেকে জেনে এসে এমি জান্নাতকে জানান, 'মেয়েদের ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না'।
পরে তিনি তার অফিসকে এ বিষয়ে অবহিত করেন। একইসঙ্গে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন যা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
এমি জান্নাত তার পোস্টে লিখেছেন, "দেশের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের মধ্যে ধর্ম উপদেষ্টাকে শুধু আলাদা করে ছেলেদের সেবায় কাজ করার জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে কি না, প্রশ্ন রেখে গেলাম। যদি এটাই হয়ে থাকে, স্পষ্টত উল্লেখ করে কাজ করার অনুরোধ।"
"একজন 'নারী' সাংবাদিক বলে নিউজ কাভার করতে পারবে না, এটা কতটা দুঃখজনক এবং অবমাননাকর, বলতে পারেন?" ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন এমি জান্নাত।
মন্ত্রণালয় থেকে অনুষ্ঠানটি কাভার করতে যে আমন্ত্রণ করা হয়েছে তাতে নারী রিপোর্টার পাঠানো যাবে না এমন বিষয় কেন উল্লেখ করা হয়নি সে বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এর আগেও বহুবার এ সংক্রান্ত প্রোগ্রাম কাভার করতে গিয়ে করতে না দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে মিজ জান্নাত লিখেছেন, "আবার তাদের মধ্যেই অনেককে ভেতরে সসম্মানে ঢুকতে দিয়েছেন, আমাদের সহকর্মী ভাইয়েরা জায়গা করে দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো দেশের দায়িত্বে থাকা সুনির্দিষ্ট কারও প্রোগ্রাম না হওয়ায় চুপ থেকেছি।"
এমি জান্নাত ধর্ম উপদেষ্টার অনুষ্ঠানে নারীদের প্রবেশ নিয়ে এ ধরনের নির্দেশনা যারই হোক সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারেন কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
ফেসবুকে এমির এই পোস্টের পরে দেশটির গণমাধ্যমকর্মীদের অনেককেই এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে ধর্ম উপদেষ্টা খালিদ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তিনি এই ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। তিনি জানান, "আমি ওই অনুষ্ঠানে মাত্র এক ঘণ্টা ছিলাম, অনেক সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তবে আমি জানতাম না নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "যদি বিষয়টি জানতাম, তবে আমি প্রয়োজনে এমি জান্নাতের সঙ্গে কথা বলতাম। কিন্তু রাত গভীর হওয়ার কারণে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। আজকেও এটা নিয়ে ফেসবুকে নানা কথা হয়েছে।"
পরে কওমী উদ্যোক্তার পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতি পড়ে শোনান তিনি। উপদেষ্টা দাবি করেন, "এই দায় তো আমার ওপর কোনো দিন নয়। আমি তো তাদের অনুষ্ঠানে গেস্ট হিসেবে গেছি। একটা পজিটিভ মানসিকতা নিয়ে গেছি যে আসুক না আলেমরা উদ্যোক্তা হিসেবে আসুক।"
এদিকে, 'কওমী উদ্যোক্তা' প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি রোকন রাইয়ান বৃহস্পতিবার সকালে জানান, এই 'অনাকাঙ্ক্ষিত' ঘটনার জন্য ধর্ম উপদেষ্টার কোনো দায় নেই। তিনি বলেন, "এখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমাদের অনুষ্ঠানে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মতো কোনো নীতি কখনো ছিল না। অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং সবাই অংশগ্রহণ করতে পারছিল। তবে এক জন অডিয়েন্সের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।"
আরেকটি নারী সাংবাদিকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা জানাচ্ছি যে, আমাদের এক স্বেচ্ছাসেবক নিজে চ্যানেল আইয়ের এক নারী সাংবাদিককে অনুষ্ঠানস্থলে বসিয়েছেন। আমি তার নামটি উল্লেখ করতে পারছি না।"
এই ঘটনার জন্য রোকন রাইয়ান এটিকে 'একটা ভুল' হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, "ধর্ম উপদেষ্টাকে নিয়ে অভিযোগ করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের কোনো ধরনের ভুল পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা ছিল না, যাতে নারী সাংবাদিকদের বাধা দেওয়া হয়। এটা একেবারেই একটি মিসটেক ছিল।"
রোকন রাইয়ান আরও বলেন, "আমরা নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করি, তাই কেন আমরা নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেব? এটা আমাদের অনুষ্ঠান এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অযৌক্তিক।" তিনি জানান, অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলেম-ওলামাদের দিক থেকে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয় এবং একটি অডিয়েন্সের কারণে এ ধরনের ভুল হয়ে থাকতে পারে, যা তিনি অতি নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, "আমাদের অনুষ্ঠানে নারীদের বাধা দেওয়ার জন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না এবং এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল ঘটনা। আমরা বিশ্বাস করি না যে, নারীদেরকে কোনওভাবেই বাধা দেওয়া উচিত। এটি আসলে একটা মিসটেক ছিল, যা আমাদের আগত কোনো অডিয়েন্সের কারণে ঘটেছে।"
শেষে রোকন রাইয়ান বলেন, "এতে কোনো দোষ ধর্ম উপদেষ্টার নয়, আমরা আয়োজক হিসেবে দোষী।" সূত্র : বিবিসি বাংলা