উত্তর বাংলা ডেস্ক : তাদের সামনে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল, পদে পদে নানা কথা শুনতে হয়েছে তাদের। তবে সেসবে কান না দিয়ে তারা এগিয়েছেন সহজাত গতিতে। নিজেদের স্বপ্নকে সত্যি করতে, স্ব স্ব ক্ষেত্রে শিখরে আরোহণ করতে তারা সব বাধাকে তুচ্ছ করেছেন। পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল সমাজে থেকেও বিদায়ী বছরে তারা বিশ্বের সামনে নিজেদের মাথা উঁচু করেছেন, দেশকেও এনে দিয়েছেন সম্মান।
২০২৪ সালে বিজ্ঞান, ক্রীড়া, বিনোদন, ব্যবসাসহ নানা পেশায় যেসব পাকিস্তানি নারীরা নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, তাদের সাফল্যের গল্প নিয়েই এই লেখা–
আয়লা মাজিদ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট
এই বছর প্রথম পাকিস্তানি এবং দক্ষিণ এশিয়ান হিসেবে অ্যাসোসিয়েশন অব চার্টার্ড সার্টিফাইড অ্যাকাউন্টেন্টের (এসিসিএ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আয়লা মাজিদ। এই পদে এক বছর দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। এই সময়ে আয়লা বিশ্বের ২ লাখ ৫২ হাজার নিয়মিত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট আর ৫ লাখ ২৬ হাজার ভবিষ্যৎ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের নেতৃত্ব দেবেন।
সালিমা ইমতিয়াজ, ক্রিকেট আম্পায়ার
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন পুরুষ আম্পায়ার নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে আসাদ রউফ, আলিম দার, আহসান রাজাদের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে পাকিস্তানের নারী আম্পায়াররা সে তুলনায় পাদপ্রদীপের আড়ালেই ছিলেন।
সে ধারা ভেঙেছেন সালিমা ইমতিয়াজ। নিজের প্রতিভার জোরে প্রথম পাকিস্তানি নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্যানেলের সদস্য হয়েছেন তিনি। এর মাধ্যমে নারীদের যেকোনো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ এবং বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিং করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন তিনি।
মাহরাং বালোচ, অধিকারকর্মী
পাকিস্তানের অস্থিতিশীল অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম বেলুচিস্তান। স্বাধীনতাকামী কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াইয়ে বরাবরই উত্তপ্ত থাকে এই প্রদেশের পরিস্থিতি। মাহরাং বালোচ একজন বেলুচিস্তানি অধিকারকর্মী। যিনি তার প্রদেশে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দৃপ্তকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর তার ডাকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন শতশত নারী। তারা নিজেদের ‘স্বামী, সন্তান, ভাইদের ন্যায়বিচারের’ জন্য এই পদযাত্রায় শামিল হন।
বালুচদের অধিকারের জন্য তার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিখ্যাত টাইম সাময়িকী। তাদের ২০২৪ সালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় জায়গা হয়েছিল মাহরাংয়ের। এর পাশাপাশি বিবিসির ২০২৪ সালে ১০০ নারীর তালিকাতেও উঠেছে তার নাম।
হাদিকা কিয়ানি, সংগীতশিল্পী
মাহরাং বালোচের মতো বিবিসির ২০২৪ সালে ১০০ নারীর তালিকায় জায়গা পেয়েছিলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী হাদিকা কিয়ানিও। দেশটিতে ভয়াবহ বন্যার সময় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বীকৃতিস্বরূপ ওই তালিকায় স্থান করে নেন তিনি।
বন্যাদুর্গতদের জন্য নিজের সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা করেছেন হাদিকা। নিজের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে দুর্গতদের কষ্টের কথা পৌঁছে দিয়েছেন সবার কাছে।
নব্বইয়ের দশকে নিজের সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের মোহিত করা হাদিকা ২০২২ সালে পাকিস্তানে বন্যার সময় ত্রাণ কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বালুচিস্তান এবং দক্ষিণ পাঞ্জাবে বন্যার্তদের সহায়তা করতে তিনি ‘ওয়াসিলা-এ-রাহ’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করেন।
সে প্রকল্পের মাধ্যমে গতবছর বন্যায় সর্বস্ব খোয়ানো মানুষদের ৩৭০টি বাড়ি বানিয়ে দেন হাদিকা। এছাড়াও সে পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় আরও বিভিন্ন সহায়তা করার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন এই সংগীতশিল্পী।
আরুজ আফতাব, সংগীতশিল্পী
বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানের জনপ্রিয় অনলাইনভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠান ‘কোক স্টুডিও’তে ‘মেহরাম’ গানটি গেয়ে সংগীতপ্রেমীদের নজর কাড়েন আরুজ আফতাব। সে বছরই প্রথম পাকিস্তানি নারী সংগীতশিল্পী হিসেবে দুটি ক্যাটাগরিতে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পান তিনি।
এর মধ্যে বেস্ট নিউ আর্টিস্ট ক্যাটাগরিতে জিততে না পারলেও বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক পারফরম্যান্স ক্যাটাগরিতে ঠিকই পুরস্কার জয় করেন আরুজ। এরপর ২০২৩ এবং ২০২৪ সালেও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পান তিনি। তবে এই দুই বছরে কোনো পুরস্কার হাতে ওঠেনি তার।
২০২৫ গ্র্যামিতেও দুটি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছেন আরুজ। এর মধ্যে তার ‘নাইট রেইন’ অ্যালবামটি ‘বেস্ট অলটারনেটিভ জ্যাজ অ্যালবাম’ এবং ‘রাত কি রানি’ গানের জন্য ফের ‘বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক পারফরম্যান্স ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছেন তিনি।
ফাতিমা সানা, ক্রিকেটার
২০১৭ সালে ১৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষেক হয় ফাতিমা সানার। অভিষেকের অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে দলের বোলিং অ্যাটাকের প্রধান অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮৭ ম্যাচ খেলে ৮৬ উইকেট পেয়েছেন তিনি, যা পাকিস্তানের নারী পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ঠিক আগে অভিজ্ঞ নিদা দার হঠাৎ নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিলে ফাতিমা সানার কাঁধে ওঠে সেই দায়িত্ব। পাকিস্তান নারী ক্রিকেট দলের সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক বনে যাওয়া ফাতিমা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেন।
বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে ম্যাচ জয়ের কৃতিত্ব দেখান ফাতিমা। দল টুর্নামেন্টে খুব একটা আলো ছড়াতে না পারলেও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে উজ্জ্বল ছিলেন এই ক্রিকেটার।
মাহিরা খান, অভিনেত্রী
পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাহিরা খান। কাজ করেছেন বলিউডেও। জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘হামসাফার’ বা শাহরুখ খানের বিপরীতে ‘রইস’ সিনেমায় তার অভিনয় এখনো সিনেমাপ্রেমীদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।
গত নভেম্বরে সিনেমা এবং সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সম্মানিত করেছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্স।
পরিবারের প্রথম নারী সদস্য হিসেবে বিদেশ সফর করা থেকে শুরু করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিনোদন অঙ্গনে অবদানের জন্য সম্মানিত হওয়া–মাহিরা খানের এই গল্প নিঃসন্দেহে নারীদের অনেক অনুপ্রাণিত করবে।
সাইমা সালিম, বিজ্ঞানী
এই বছর করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী অধ্যাপক ড. সাইমা সালিমকে বর্ষসেরা নারীর পুরস্কার প্রদান করেছে রাশিয়ান সেন্টার ফর সাইন্স অ্যান্ড কালচার। নারীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত পড়তে উৎসাহিত করার জন্য এই স্বীকৃত পেয়েছেন তিনি।
রিসার্চ গেট-এর তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৪৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সাইমা সালিম। এসব গবেষণাপত্র রিসার্চ গেট-এ প্রায় ৬ হাজার ২০০ বার পড়া হয়েছে এবং ২২৯ বার সাইটেশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
শায়েস্তা আসিফ ও শাজিয়া সৈয়দ, উদ্যোক্তা
পাকিস্তানের দুই নারী ব্যবসায়ী শায়েস্তা আসিফ এবং শাজিয়া সৈয়দ সম্প্রতি ফোর্বসের ‘মিডল ইস্ট’স ১০০ মোস্ট পাওয়ারফুল বিজনেসউইমেন ২০২৪’ তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে পিউর হেলথ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রুপ সিইও শায়েস্তা তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছেন। ২০০৬ সালে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর তার মেধা আর পরিশ্রমেই সাফল্য পেয়েছে পিউর হেলথ। এর পুরস্কার হিসেবেই ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পিউর হেলথ-এর গ্রুপ সিইও হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।
অন্যদিকে শাজিয়া দীর্ঘসময় ধরে কাজ করছেন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের সঙ্গে। ১৯৮৯ সালে ইউনিলিভার পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার পর একসময় প্রতিষ্ঠানটির সিইও’র দায়িত্বও পালন করেছেন। এছাড়া ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড, পুক্কা টি এবং পেপসি লিপটনের মতো প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এখন ইউনিলিভার উত্তর আফ্রিকা, লেভান্ট অ্যান্ড ইরাকের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শাজিয়া। এছাড়া ইউনিলিভার অ্যারাবিয়া’র সিনিয়র কাস্টোমার ডেভেলপমেন্ট লিড হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।