শেখ মাজেদুল হক : বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। সমাজের নারীদের অবস্থা দেখে তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও শিক্ষাহীন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল নারীদের মুক্তি দেওয়া এবং সমাজে নতুন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা। রোকেয়া “নারী জাগরণের অগ্রদূত” হিসেবে পরিচিত, এবং তাঁর কাজ ছিল নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য একটি উন্নত সমাজ গঠন করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীর অধিকার ও শিক্ষার জন্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করা উচিত নয়; বরং নারীদের মননে স্বাধীনতা ও শিক্ষা প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন, “নারীর সমস্যা সমাধানের জন্য নারীকে সচেতন হতে হবে, অন্যথায় কোন সমাজ তাদের জাগিয়ে তুলতে পারবে না।
” রোকেয়ার চিন্তাধারা ও দর্শন কেবল নারীদের জন্য নয়, বরং পুরুষদের জন্যও একটি কল্যাণকর সমাজ তৈরির লক্ষ্যে নিবদ্ধ ছিল। তাঁর রচনা ও কার্যক্রম সমাজের মুরব্বিদের চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারীদের মৌলিক অধিকার ও সমানত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আন্দোলন সৃষ্টি করেছে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর প্রবন্ধ ‘আমাদের অবনতি’-তে পুরুষদের ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশ হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে নারীদের অন্ধকারে রাখার বিষয়ে আলোচনা করেন।
তিনি যুক্তি দেন, যদি সত্যিই ঈশ্বর নারীদের শাসনের জন্য দূত পাঠাতেন, তবে সেই দূত শুধু এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকতেন কেন? ইউরোপ ও আমেরিকায় তাঁর আদেশ শোনানো হয়নি কেন? রোকেয়া ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সমালোচনা করে বলেন, “যেখানে ধর্মের প্রভাব বেশি, সেখানেই নারীদের ওপর অত্যাচার বেশি। আর যেখানে ধর্মের প্রভাব কম, সেখানেই নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারে থাকে।” তিনি সমাজের মুরব্বিদের দ্বারা আরোপিত ধর্মের নীতির নামকে অধর্ম বলে অভিহিত করেছেন এবং এটিকে সমাজের ক্ষতি হিসেবে দেখেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “আমাদের কাঠমোল্লা মুরব্বিরা ধর্মের নামে নারীদের শাসনের চেষ্টা করছেন।
” রোকেয়া ধর্ম সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “যখনই কোনো নারী মস্তক উঁচু করার চেষ্টা করেছেন, তখনই ধর্মের দোহাই দিয়ে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।” তিনি বুঝতে পারেন, “ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন আরও শক্ত করেছে, যেখানে পুরুষ এখন নারীদের ওপর প্রভুত্ব করে।” তিনি একটি স্বপ্ন দেখতেন যেখানে এক ঈশ্বরকে বিভিন্ন নামেই ডাকা হয়। তাঁর মতে, “এক দেশে যেখানে এক ঈশ্বরের উপাসনা নানা নামে হয়, সেখানে সকলেই এক গন্তব্যের দিকে বিভিন্ন পথে চলছে।” তিনি মনে করতেন, “প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির প্রধান কারণ ধর্ম।” রোকেয়া ধর্মীয় চর্চার ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে নজর দিয়েছেন। তিনি ইসলামী শিক্ষার প্রসারের তাগিদ দেন এবং বলেন, “শৈশব থেকে আমাদের কুরআন মুখস্থ করানো হয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তার অর্থ জানে না।” তাঁর মতে, নারীদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কুরআন শিক্ষাদান অপরিহার্য।
তিনি বলেন, “কুরআন শিক্ষার অর্থ কেবল আরবি শব্দের আবৃত্তি নয়; বিভিন্ন ভাষায় কুরআনের অনুবাদ শিক্ষা দিতে হবে।”নারীদের শিক্ষা এবং স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ধর্মকে বাধা হতে না দেওয়া উচিত বলেও রোকেয়া উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আমি নারীদের কল্যাণ কামনা করি এবং তাঁদের ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন না করে একটি উন্মুক্ত জীবনের আহ্বান জানাচ্ছি।” বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ‘রোকেয়া-জীবনী’তে উল্লেখ করেছেন, রোকেয়া তাঁর জীবনের বহু কথা আলোচনা করতে বলেছেন। তিনি ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে প্রথম মুসলিম মেয়েদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা নারীদের শিক্ষাহীনতা ও অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য কাজ করে। রোকেয়ার মূল লক্ষ্য ছিল নারীদের আত্মসম্মান এবং স্বাবলম্বী করে তোলা। তিনি তাঁর কর্মে দেখিয়েছেন, নারীর মধ্যে চেতনা জাগানোর জন্য তাঁর চিন্তা ছিল কর্মমুখী। তিনি নারীদের শিক্ষা এবং মুক্তির জন্য কাজ করেছেন এবং সমাজের অন্যায় দিকগুলোকে চিহ্নিত করেছেন।
বঙ্গীয় সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা রোধে রোকেয়া গুরুত্ব দিয়েছেন এবং নারীদের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি জানতেন, নারীরা যদি নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে না পারে, তবে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা এবং কর্মকাণ্ড সমকালীন নারীবাদের জন্য একটি প্রেরণা। তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। আজকের বাংলাদেশে নারীবাদীদের কাছে রোকেয়া একটি মূর্ত প্রতীক। তাঁর চিন্তা ও দর্শন এখনও প্রাসঙ্গিক, এবং আমাদের সমাজের উন্নয়নের জন্য তাঁর আদর্শ অনুসরণ করা উচিত। রোকেয়া বিশ্বাস করতেন যে, ধর্ম নারীদের স্বাধীনতা ও উন্নয়নকে বাধা দিতে পারে না, বরং এটি তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে। তিনি নারীদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করেছেন, তা নারীর মর্যাদা ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
রোকেয়ার দর্শন কেবল নারীদের জন্য নয়, বরং সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য কল্যাণকর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নিবদ্ধ। তার দর্শন ও কাজ আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আধুনিক সমাজে নারীর অধিকারের প্রশ্নে নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। বর্তমান সময়েও, বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা নারীদের আন্দোলন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নারীর অধিকার, শিক্ষা, এবং স্বাধীনের জন্য তাঁর সংগ্রাম আমাদের জন্য আজও একটি শক্তিশালী প্রেরণা। আজকের দিনে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বঙ্গ সমাজের প্রথম নারীবাদী হিসেবে, তিনি শিক্ষাহীন নারীদের মুক্তির জন্য আলো জ্বেলেছেন। রোকেয়ার চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনও আমাদের সমাজের নারীদের জন্য পথপ্রদর্শক।
লেখক: শেখ মাজেদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক ,মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর