আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ● ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
 
 width=
 
 
 width=
 
শিরোনাম: বাদ যাচ্ছে সাড়ে ১২ বছরের কম বয়সী ২১১১ মুক্তিযোদ্ধার নাম       পঞ্চগড়ে সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশকালে ৫৬ বিজিবি কর্তৃক ৫ জন আটক       বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ অব্যাহত থাকার প্রতিশ্রুতি       ১৫ বছরের মরে যাওয়া শিপিং কার্যক্রমে গতি আনছে অন্তর্বর্তী সরকার: নৌ-পরিবহন সিনিয়র সচিব       মানবিকতাবোধহীন শিক্ষা দিয়ে কী লাভ ?      

 

মানবিকতাবোধহীন শিক্ষা দিয়ে কী লাভ ?

বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, রাত ০৮:১৪

মো.  শহিদুল ইসলাম : আমাদের ছেলে-মেয়ে, শিক্ষার্থীরা যখন ভালো ফলাফল করে, উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে তখন আমরা তাদের খুব প্রশংসা করি, ভালো বলি, তাদের নিয়ে গর্ববোধ করি। কিন্তু উচ্চতর ডিগ্রী/ভালো ফলাফল অর্জনের পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবি কি? সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষার হার বাড়ছে, বাড়ছে উচ্চতর ডিগ্রীধারীর সংখ্যা। কিন্তু এই শিক্ষা এবং উচ্চতর ডিগ্রী দ্বারা আমাদের মানবিক উন্নয়ন ঘটছে কি? দুর্নীতি, অপরাধবোধ, মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা, মনুষ্যত্বহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, অবহেলা, আত্মঅহমিকা, গোঁড়ামি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, অসদাচরণ, নির্দয়তা, ধৈর্যহীনতা, সুযোগসন্ধানী, কৃপণতা, সাহায্যহীনতা ও আরো অনেক অনেক কিছু; এসব কমছে কি?  পরিবার, সমাজে, শিক্ষাক্ষেত্রে সততা, পরোপকার, আত্মত্যাগ, একনিষ্ঠতা, শ্রদ্ধাশীলতা ,দুর্নীতিহীনতা সর্বোপরি ইতিবাচক মানবিক গুণাবলিগুলোর চর্চা বা শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে কি? আমাদের ছেলে-মেয়েদের সর্বক্ষেত্রে প্র্যাকটিক্যালি ইতিবাচক মানবিক গুণাবলি চর্চা এবং শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেন না মুখে মুখে যতই শিক্ষা দেয়া হোক না কেন বাস্তবিকভাবে/ কর্মে প্রদর্শন করতে না পারলে আমাদের ছেলে-মেয়ে/শিক্ষার্থীরা কখনও এসব শিখবে না‌। কারণ তারা শুনে শিখে না ,দেখেই শিখে।  মানুষের নানামাত্রিক অমানবিক কর্মকাণ্ড আমাদের মনে সর্বদা ভয়, সন্দেহের সৃষ্টি করছে। এসবের মোকাবেলায় আমরা নিজেদের শারীরিকভাবে দীর্ঘ, সুঠাম এবং অস্ত্রধারী হতে পছন্দ করি/ প্রচণ্ড রকম চেষ্টা করি। ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্নয়নের মরণপণ চেষ্টা করি। তবে চূড়ান্তভাবে কল্যাণ হয় না কখনোই।  অথচ এত জটিলতায় না যেয়ে সরলভাবে ইতিবাচক মানবিক গুণাবলির দ্বারা যদি আমরা সমাজটাকে পূর্ণ করে দিতে পারি তাহলে প্রতি অবস্থায়, প্রতি ক্ষণে আমরা সত্যিকারের  নিরাপদবোধ, আরামবোধ  করব।

 

 বিলাসিতা, স্বার্থপরতা, ক্ষমতা প্রদর্শন, স্বেচ্ছাচারিতা, মিথ্যা, বর্ণবৈষম্য, শ্রেণিভেদ, জাতিভেদ এসব আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত জ্যামিতিক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের পরেও আমরা বলি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা অনেক বেশি আধুনিক, খুবই আধুনিক, খুবই সভ্য!  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হিটলারের নাজি কন্সেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়া কোন একজন বন্দি মানুষ তাঁর প্রিয় শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন; “আমি একজন ভাগ্যবান। আমি হিটলারের কন্সেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্ত আকাশের নিচে পৃথিবীর বুকে ফিরছি। আমি হিটলারের নাজি কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে যে দৃশ্য দেখেছি তা সকলের দেখা উচিত: আমি দেখেছি গ্যাস চেম্বার তৈরি হয়েছে শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা।
আমি দেখেছি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়েছে শিক্ষিত কেমিস্ট দ্বারা। আমি দেখেছি শিক্ষিত ডাক্তাররা কীভাবে বাচ্চাদের বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছে। আমি দেখেছি শিক্ষিত নার্সরা কীভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে অসহায় মানুষদের। এতো স্রেফ বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ মাত্র। স্কুল, কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষিত হাজার হাজার মানুষকে আমি প্রতিদিন নির্বিচারে শিশু, 

মহিলাসহ অসহায় মানুষের কাতর আর্তিতে কর্ণপাত না করেও উল্লাসের সাথে মানুষ হত্যা করতে দেখেছি। এসব কিছু দেখার পর এখন আমার শিক্ষার প্রতি সন্দেহ হয়। মনে হয় শিক্ষা অর্থহীন একটা বিষয়। তাই আপনার প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি আপনার ছাত্রদের কেবল পাঠ্যপুস্তক না পড়িয়ে মানুষ হয়ে উঠতেও সাহায্য করুন। একটা জিনিস সর্বদা খেয়াল রাখবেন, আপনার শিক্ষায় যেন কোন শিক্ষিত দৈত্য, জ্ঞানী শয়তান, সর্বজ্ঞ মূর্খ তৈরি না হয়। লিখতে, পড়তে শিখে, জটিল জটিল অঙ্ক আয়ত্ত করে, বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কার করে যদি মানুষ হয়ে মানুষের উন্নতিই না করা সম্ভব হয় তাহলে কীসের শিক্ষা? দয়া করে লক্ষ্ রাখবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেনো স্রেফ শিক্ষিত হওয়ার চেয়েও বড় কিছু হয়, ওরা যেনো মানুষ হয়।”

 

আদিম যুগ হতে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্লেষণ করা হলে দেখতে পাওয়া যাবে- যে অঞ্চল বা সমাজে  অপরাধবোধ, অনৈতিকতা ইত্যাদির মাত্রা বেশি ছিল; সে অঞ্চল বা সমাজ কালের পরিক্রমায় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগতভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। একেবারে ধ্বংস না হলেও খুবই ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে একথা অনস্বীকার্য।

 

মানবিকতাবোধহীন সমাজব্যবস্থা কখনোই স্থায়ী হতে পারেনি/পারে না। আমরাও কি মানব জাতির চূড়ান্ত ধংসকেই ত্বরান্বিত করছি? অনৈতিক, মানবতাবোধহীন কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করতে করতে আমরা হয়ে পড়ছি পর্যুদস্ত। মানবতাবোধ যেন এখন  অতি অণুবীক্ষণিক যন্ত্র দিয়ে খুঁজে পেতে হয়। জাতি, বর্ণ, শ্রেণি ও প্রথাগত বৈষম্য সময়ের সাথে বড্ড বেশি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আমরা স্বজাতি, স্ববর্ণ, স্বগোত্রর বিজয়ে যতটা আনন্দ লাভ করি অন্যদের অর্জনে হয়তো তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট অনুভব করি! আমরা কি আধুনিক শুধু অহমিকায়, প্রতারণায়, হিংসায়, কলহ ইত্যাদিতে?

 

আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেই লোভের, অর্থের, বিত্তের, ক্ষমতার এবং পদ মর্যাদার। আমরা তাদের সব সময় সর্বোচ্চ চূড়াটি গন্তব্য হিসেবে দেখিয়ে দিতে পছন্দ করি এবং যেকোনোভাবে সেটি অর্জনে শিক্ষা দেই। কিন্ত তাদেরকে মানবতাবোধের ব্যাপারে কতটুকু শিক্ষা দেই? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যেদিন কোন এক প্রাণের কষ্টে/ব্যথায় পুরো পৃথিবীর সবাই ব্যথিত হবে, তার আনন্দে আনন্দিত হবে এবং বিজয়ী যেই হোক না কেন উৎযাপন হবে সবার, সেদিনই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে ।


মো.  শহিদুল ইসলাম, প্রভাষক (ভূগোল)

রংপুর ক্যাডেট কলেজ, রংপুর ।

Email: sahidulislamges@gmail.com

মন্তব্য করুন


 

Link copied