ঢাকা: বিগত সময়ে দেশে যেসব সাফল্য ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিকল্পিত পরিবার গঠন। কিন্তু সেই সাফল্যে যেন ভাটা পরেছে।
কমেছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পিত পরিবার গঠনে সরকারের দৃষ্টি ঠিক আগের মত নেই। প্রচার-প্রচারণায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দামও অনেক বেড়েছে। আবার কর্ম জীবনের ব্যস্ততা, স্বামী-স্ত্রী দুই স্থানে বসবাস, জীবিকার তাগিদে বিদেশ গমন, এসব কারণে কমছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১৫ সালের পর এই হার সর্বনিম্ন।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার, ২০১৫ সালে ছিল ৬২ দশমিক এক শতাংশ, ২০১৬ সালে ছিল ৬২ দশমিক তিন শতাংশ, ২০১৭ সালে ছিল ৬২ দশমিক পাঁচ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ৬৩ দশমিক এক শতাংশ, ২০১৯ সালে ছিল ৬৩ দশমিক চার শতাংশ, ২০২০ সালে ছিল ৬৩ দশমিক নয় শতাংশ, ২০২১ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ছয় শতাংশ, ২০২২ সালে ছিল ৬৩ দশমিক তিন শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ছিল ৬২ দশমিক এক শতাংশ। অর্থাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমে ৮ বছর আগের অবস্থানে চলে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি নেওয়ার হার ৬১ শতাংশ এবং সনাতন পদ্ধতি নেওয়ার হার ১ শতাংশের বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামে পদ্ধতি ব্যবহারের হার কম। এ হার শহরে প্রায় ৬৪ শতাংশ, গ্রামে প্রায় ৬২ শতাংশ।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে যাওয়ার পেছনে একদিকে সরকারি সেবার মান ও মনোযোগ কমে যাওয়া যেমন দায়ী, তেমনি অসচেতনতা, দারিদ্র্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি নেয়ার প্রবণতা কমছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ এবং চিকিৎসকেরা বলছেন, আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার কমলে গর্ভপাত ও গর্ভপাতের কারণে মৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা থাকে। জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কেন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তা ভালোভাবে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কেন কমছে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বাংলানিউজকে বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার কমার কারণগুলো হচ্ছে, মানুষ এখন দেরিতে বিয়ে করছে, এছাড়াও কর্মস্থলে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে স্বামী স্ত্রী কর্মজীবনের কারণে দুইজন দুই জায়গায় বসবাস করছে। এর ফলে আগে যেমন বছরের পর বছর নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খেত এখন তারা সেটা খাচ্ছে না। দেশে বন্ধ্যাত্বের সমস্যাও আগের থেকে বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার কমার আরেকটা বড় কারণ এখন অনেক লোক বিদেশে থাকে। প্রবাসে থাকা এসব মানুষের স্ত্রীদের অধিকাংশই দেশেই থাকেন। প্রবাসী শ্রমিকরা তিন-চার বছরে একবার হয়তো এক দুই মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। অর্থাৎ স্বামী যদি দেশে একসাথে থাকতো তাহলে একটা বাচ্চা নেওয়ার পর হয়তো যে মহিলা তিন বছর একটানা পিল খেত, তিনি এখন কোনো জন্ম নিরোধ ব্যবহার করছেন না। তার স্বামী যখন দেশে আসবে হয়তো এক মাসের জন্য তিনি সাময়িক সময়ে কনডম কিংবা অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ দেশের বাইরে অবস্থান করছে। স্বামী-স্ত্রী দূরে থাকার কারণে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ছে না।
আবার অনেকেই কর্মজীবনের কারণে স্বামী-স্ত্রী দুইজন দুই জেলায় থাকেন। এর ফলে তারা সপ্তাহে একদিন একসাথে থাকার সুযোগ পান। মানুষের জীবনধারার এই পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমেছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কম ব্যবহারের প্রভাব কি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের জনসংখ্যা এখনো কিন্তু কমের দিকেই রয়েছে, এমন নয় যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করার ফলে জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োজন হচ্ছে না বলেই ব্যবহার কমছে। এর ফলে খুব বেশি জনসংখ্যার উপর প্রভাব পড়বে না।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার খুব যে কমেছে তা নয়। আমাদের বাল্যবিয়ের হার অনেক কমেছে। কমিউনিটিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ উপকরণের কিছুটা ঘাটতি ছিল, তার প্রভাবেও ব্যবহার কিছুটা কমতে পারে। দীর্ঘদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণ উপকরণের ঘাটতি থাকলে তার প্রভাব বেশি পড়বে। তবে শিগগিরই আমাদের এই ঘাটতি দূর হয়ে যাবে।