নিউজ ডেস্ক : বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে কিছুটা উত্তাপ ছড়িয়েছে। এই উত্তাপকে কেন্দ্র করে আবার ছড়িয়ে পড়েছে নানা গুজবও। জনমনেও কৌতূহল বেড়েছে- কী হচ্ছে, কী হবে।
তবে এমন পরিস্থিতিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি আর উত্তাপ না বাড়িয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকবে, যাতে দেশে আর কোনো রাজনৈতিক সংকট তৈরি না হয়। কারণ দেশে সংকট তৈরি হলে ‘রাজনৈতিক লোকসান’ বিএনপিরই বেশি হবে বলে দলটির নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি সমর্থক ও সুধী সমাজের প্রতিনিধিরাও মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য না হলেই ভালো হতো। এটা দুঃখজনক। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য থেকে বড় ধরনের কিছু হবে বলেও মনে হয় না। রাজনীতিবিদরা এই ধরনের কথা বলে থাকেন। এগুলো মূলত একে অপরকে চাপে রাখার একটা কৌশল।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে নিরপেক্ষ ভোটের আয়োজন করতে হবে। নির্বাচনের জন্য পুলিশ, প্রশাসন, আমলা, ভোটার তালিকাসহ নানা কিছু প্রয়োজন। ফলে এগুলো ঠিক করতে একটু সময় লাগবে। এটা সব পক্ষকেই বুঝতে হবে। আলাউদ্দিনের চেরাগ কারও কাছে নেই যে বসলেই সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। একে অপরকে সন্দেহ-অবিশ্বাস করলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষ যে আশা দেখতে পেয়েছিল তা হতাশ করা হচ্ছে।
রাজনীতিবিদরা এগুলো না করলেই পারেন। আর যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের বাদানুবাদে লিপ্ত না হওয়াই শ্রেয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, এখন তো দেশে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ নেই। গণতান্ত্রিক দেশে সবাই সব ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন। এটাই ডেমোক্রেসি। বিএনপি যতদ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়।
তিনি বলেন, এখন তো কোনো দলই সরকারে নেই। সরকারে থেকে কেউ যদি দল করে তাহলে তো নিরপেক্ষতা হারাবে। সরকার থেকে কেউ যদি দল গঠন করে তাহলে সেটা ‘কিংস পার্টি’ হবে। তাহলে তারা সরকারে থাকতে পারবে না। রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, রাজনীতিতে তারা এখন কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। কারণ যেকোনো প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হোক না কেন, বড় দল হিসেবে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি। কারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ এখনো অনিশ্চিত। জাতীয় পার্টিও নানামুখী চাপের মুখে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নানামুখী তৎপরতা থাকলেও তাদের ভোট ৭ শতাংশের বেশি নয়।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ফলে সারা দেশে ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালালেও আগামী নির্বাচনে তাদের ভোট কত শতাংশ বাড়বে, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। আর ভোট বাড়লেও বিএনপির কাছাকাছি যাবে এমন সম্ভাবনার কথা কেউ বিশ্বাসও করে না। বাকি দলগুলোর ভোট পাওয়ার শতকরা যে হার, তা ক্ষমতায় যাওয়ার মতো নয়। ক্ষমতায় যেতে হলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট লাগবে। সুতরাং সবদিক থেকে বিএনপিই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে।
বিগত চারটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.০৮ শতাংশ ভোট। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.৬১ শতাংশ ভোট। ২০০১ সালে বিএনপি ৪০.৮৬ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে, আর আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৩.২০ শতাংশ ভোট পায়। সেই হিসাবে আগামী দিনেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে হলে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট প্রয়োজন।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের সম্মুখ সারিতে ছাত্রসমাজ থাকলেও এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী বিএনপি। তাই তুচ্ছ ঘটনায় বা সংকট সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ হারাতে বিএনপি রাজি নয়। পাশাপাশি অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা বা অঘটন ঘটলে তার দায় বিএনপির ওপর যাতে না বর্তায়, সেই লক্ষ্যে দলটি সতর্ক থাকতে চায়।
জানা গেছে, কৌশলগত এমন অবস্থানের কারণেই আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন পর্যন্ত বিতর্কিত কোনো মন্তব্য করেননি। প্রথম থেকেই বক্তব্য-বিবৃতিতে সংযত থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক দিক থেকে ইতিবাচক অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছেন তারেক রহমান। গত ৬ মাসে তার বক্তব্য-বিবৃতি সুধী সমাজের মধ্যেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।
সূত্রমতে, বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের গত দুই দিনের বক্তব্য নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক ওই সব আলোচনায় হঠকারী কোনো কথা না বলার জন্য দলের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারেক রহমান বলেছেন, সবাইকে সংযত হয়ে গঠনমূলক বক্তব্য দিতে হবে, যাতে জুলাই-আগস্টের বিপ্লব তথা বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথ ভণ্ডুল না হয়।
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে নির্বাচনের সময় একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারলে নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে না। মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। এরপর থেকেই পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, উপদেষ্টারা কেউ রাজনীতি করলে সরকার থেকে বের হয়ে করবেন। এসব বক্তব্য রাজনীতিতে বেশ উত্তাপ ছড়ায় এবং এরই সূত্র ধরে নানা গুজব ডালপালা মেলতে শুরু করে। এর আগেও সংস্কার, নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংবিধান সংশোধন ও রাষ্ট্রপতির অপসারণের উদ্যোগসহ নানা ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের মধ্যে বিভিন্ন সময় মতবিরোধ জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
এ ছাড়া প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রদবদল নিয়ে সরকার, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রসমাজের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না বলে আলোচনা আছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। কারও সঙ্গে কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি। কোনো ধরনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছি না, আমরা আমাদের গঠনমূলক বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংস্কারের জন্য নির্বাচন দরকার, আবার নির্বাচনের জন্য সংস্কার দরকার। নির্বাচন দিতে হলেও কতগুলো বিষয়ে সংস্কারে বিষয়ে সবাই একমত হবে। তবে আমরা মৌলিক সংস্কারের পক্ষে। সংস্কারের জন্য জনগণই আসল চালিকাশক্তি এবং জনগণ তার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্বাচনের মাধ্যমে। সুতরাং জনগণের ভোটেই যেন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন সে জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট হতে হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের সীমিত কিছু সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন। মৌলিক সংস্কারের জন্য নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, অবৈধভাবে চাঁদাবাজি করে দল গঠন করা যাবে না। বর্তমানে রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন জায়গায় মিটিং করতে যান সরকারের কেউ কেউ। এই টাকাগুলো কোথা থেকে এল তার হিসাব দেওয়া জরুরি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক অপরিপক্বতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দেশপ্রেমের অভাব ও নির্বাচনে দেরি- এগুলোই সমস্যার মূল কারণ। নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে দ্বন্দ্বের কি আছে? সংস্কার তো সবাই চায়। সংবিধান, প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশনসহ কয়েকটি জায়গায় মৌলিক সংস্কার করে এই বছরের নির্বাচন দিলেই সংকট কেটে যাবে। ছাত্ররা যে সংস্কার চাইছে তা এক বা দুই দিনে করা সম্ভব নয়, এটা ধারাবাহিকভাবে চলবে। অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে দেশের জন্য ক্ষতি। নির্বাচিত সরকার দেশ চালাবে এই কথাটা সবাইকে মাথায় নিতে হবে। বিএনপিকে মাইনাসের চিন্তা করলে ভুল করবে।
তিনি বলেন, ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করলে তাকে স্বাগত জানাব। কিন্তু সরকারের ভেতর থেকে ‘কিংস পার্টি’ গঠন করবে, নির্বাচন অংশ নেবে তাহলে সেই নির্বাচন কীভাবে নিরপেক্ষ হবে? প্রয়োজনে ছাত্ররা পদত্যাগ করে দল গঠন করুক। তাহলে কোনো বিতর্ক থাকবে না। ছাত্ররা দল গঠন করতে এত টাকা পাচ্ছে কোথা থেকে? এই সরকার নিরপেক্ষ না থাকলে কীভাবে সংস্কার হবে? তাই উপদেষ্টাদের সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দিয়ে সরে যাওয়া উচিত।
দিলারা চৌধুরী বলেন, নিজেদের আদর্শ ত্যাগ করে ‘কিংস পার্টি’ গঠন করলে ছাত্রদের গায়ে কালিমা লাগবে। কিন্তু ভবিষ্যতে ছাত্রদের কেউ সম্মান করবে না, তাদের সবাইকে ধান্দাবাজ বলবে। ছাত্রদের ঐতিহ্য ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া যাবে না। তাই তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করার দিকে নজর দেওয়া উচিত।