অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কালো অধ্যায় বেরিয়ে এসেছে। এতে বলা হয়, গত ১৫ বছরে অন্তত পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এ সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর ২৩ থেকে ৪০ শতাংশই লুটপাট করা হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়। এ সময় জনগণকে এক ধাঁধাঁর মধ্যে ফেলে ‘উচ্চতর প্রবৃদ্ধি’র এক কাল্পনিক গল্প শোনানো হয়। ১৫ বছরের টানা দুঃশাসনের পর গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য একটি কমিটি গঠন করে ২৮ আগস্ট। সেই কমিটি গতকাল চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। সেই শ্বেতপত্রে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই যুগান্তকারী কাজের জন্য কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা উচিত এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতিকে যে ভঙ্গুর দশায় আমরা পেয়েছি তা এই রিপোর্টে উঠে এসেছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে তারা লুণ্ঠন করেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। তারা প্রকাশ্যে এই লুটপাট চালিয়েছে। এদিকে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করেছে বলে জানান কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রতিবেদন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানান, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ সামনে ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এসব ঋণের বড় অংশ ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পাচারের টাকা ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সব সংস্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। শ্বেতপত্রের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অবৈধভাবে সুবিধা দিয়ে একটি গোষ্ঠীকে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়েছে সাবেক স্বৈরাচার সরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ওই সরকার উন্নয়নের মোড়কে জনগণকে বোকা বানিয়ে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক কাল্পনিক গল্প তৈরি করেছিল। প্রয়োজনের কয়েক গুণ বেশি ব্যয় দেখিয়ে বড় বড় ব্রিজ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে এসব প্রকল্পে অর্থের হরিলুট করেছে। আবার সেই অর্থ দলীয় নেতা-কর্মীরা অবাধে পাচারও করেছে। এ জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপের সঙ্গে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখানো হতো। একদিকে বেশির ভাগ মানুষের আয় কমলেও দলীয় নেতা-কর্মী ও উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতরা দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যেতেন। এর ফলে মাথাপিছু আয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অনেক উচ্চ হিসেবে দেখানো হতো। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডাটার ব্যবহারেও সূক্ষ্মভাবে জালিয়াতি করা হয়েছে। একই সঙ্গে নানাভাবে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের অপচয় ও লুটপাট হয়। যেমন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি, আমলাদের ইচ্ছায় প্রকল্প নেওয়া হয়। এসব প্রকল্প নিলে নিজের এলাকায় জনগণের কাছে সহমর্মিতা বাড়ে, রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাওয়া যায়। এসব প্রকল্পের ঠিকাদারিও পান প্রভাবশালীরা কিংবা তাদের পছন্দের ব্যক্তি। শুধু তাই নয় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা অপচয় বা নষ্ট হয়েছে। গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর ৪০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা লুটপাট করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে মূলত রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে এই বিপুল অর্থ লুটপাট করেছেন বিদায়ি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাভোগীরা। প্রতি বছর অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে। যা বাংলাদেশি টাকায় এক বিলিয়নে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকার সমান।
চূড়ান্ত এই প্রতিবেদনে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের পাশাপাশি এডিপির দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থের অপচয় এসব বিষয় নিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি ডলার বা ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বাজারদরে) অর্থ এডিপির মাধ্যমে খরচ হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে, এডিপির মাধ্যমে যত টাকা খরচ করা হয়েছে, এর ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অপচয় ও লুটপাট হয়ে গেছে। প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে ধরে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই ঠিকাদার বিল তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগে বিপুল অর্থ অপচয় হয়েছে। আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আবার সময়ে সময়ে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। পছন্দের ব্যক্তিদের প্রতিযোগিতা ছাড়াই ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় বহু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হয়েছে, যাদের সঙ্গে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের বিশেষ সম্পৃক্ততা ছিল। অনেক ঠিকাদার ঘুষ দিয়ে কাজ পেয়েছেন। ফলে প্রকল্পের গুণগত মান নিশ্চিত হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশে আরও সাতটি স্থলবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু কোনোটিতে বাণিজ্য বাড়েনি, কোনোটি চালু হয়নি। অথচ শত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, গত সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। পদ্মা রেলসংযোগ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হলেও এখন পর্যন্ত রেল চলে দিনে মাত্র ১০টি। ১৫ হাজার কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে চলে দিনে মাত্র ৬টি ট্রেন। এসব প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে আগামীকাল (সোমবার)। জানা গেছে, ২৪টি অধ্যায়ের সন্নিবেশিত হয়েছে দুর্নীতির বর্ণনা। অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতিবেদনের ভূমিকা, উপসংহার ও অন্যান্য সংযুক্তি রয়েছে এতে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর গতকাল এ প্রতিবেদন দাখিল করেছে। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।