আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ● ৩ কার্তিক ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৮ অক্টোবর ২০২৪
 
 width=
 
 
 width=
 
শিরোনাম: ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প       নীলফামারীতে ইউনিয়ন বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের উদ্বোধন       নীলফামারীতে প্লাষ্টিকের ব্যবহার বন্ধে মতবিনিময় সভা       ডোমারে বিএনপির সমাবেশে জনস্রোত ॥ বক্তব্য রাখেন শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিন       সাকিবের দেশে আসা স্থগিত, ব্যাখ্যা দিলেন ক্রীড়া উপদে      

 width=
 

সরকারের জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা (জানো) বদলে দিচ্ছে গ্রামীন মানুষের জীবনমান

শুক্রবার, ৭ জুন ২০২৪, রাত ০৯:০৮

তাহমিন হক ববি॥ 
নীলফামারী জেলা সদরের খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের মাঝাডাঙ্গা গ্রামে জাহানারা পারভিনের বাড়ি। বিষমুক্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজির পাশাপাশি তিনি পুকুরে চাষ করছেন বিষমুক্ত মাছ। এছাড়া আছে হাঁস, মুরগি, লেবুবাগান ও সারি সারি কলাগাছ। তিনি পতিত জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন। ঝিঙে, টমেটো, বরবটি, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, ডাঁটাশাক, লাউ, শিম, করলা, মরিচ, বেগুন, পুঁইশাক—সবই আছে জাহানারা পারভিনের (৫২) সবজিবাগানে। এসব সবজির বিশেষত্ব হলো এগুলো বিষমুক্ত, প্রয়োগ করা হয় না কোনো কীটনাশক। জৈব সার ব্যবহার করেই ফলানো হয় এসব সবজি। বাড়ির পাশের পতিত পাঁচ শতাংশ জমিতে ফলানো এসব সবজিতে আট সদস্যের পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রিও করা হচ্ছে। শুধু জাহানারা পারভিন একা নন, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এমন সবজিবাগান দেখা যায়। অনেকে পতিত জমি ছাড়াও ঝুলন্ত সবজিবাগান, বস্তায় আদা ও সবজির চাষ করছেন। বস্তায় আদা ও সবজি চাষের কারণ হিসেবে তাঁরা জানান অতিবৃষ্টিতে পানি জমে যাতে ফসলের ক্ষতি না হয়, সে কারণে বস্তায় এসব চাষ করা হচ্ছে। একই গ্রামের জবেদা বেগম (৩৮), কুলসুম বেগম (৪০), হাসিনা বানুসহ (৩৮) অনেকে বস্তায় আদা চাষ, ঝুলন্ত সবজিবাগান ও পতিত জমিতে বিষমুক্ত সবজি চাষ করে পরিবারের পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি বাড়তি আয় করছেন। গ্রামের মর্জিনা বেগমের (৪০) স্বামী গ্রামে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করেন। আর তিনি বাড়ির পাশের পতিত জমিতে এসব চাষাবাদ করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পর বাজারে বিক্রি করেন। তাতে তাঁদের সংসারে সচ্ছলতা আসছে। এসব কাজের পাশাপাশি তিনি বাড়িতে সেলাইয়ের কাজও করেন।
অপর দিকে সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের রোমানা বেগম। দশ বছর আগে রিপন ইসলামের সাথে বিয়ে হয় তার। দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই অভাব অনটনে দিন কাটে। কৃষক স্বামী অন্যের জমিতে কাজ করে। যা আয় করেন তা দিয়েই টেনে টুনে চলে সংসার। এই অভাব-অনটনের মাঝে দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের ঘরে আসে তিন ছেলে মেয়ে। পাঁচজন সদস্যের সংসারে ভরনপোষন যোগান দিতে দিশেহারা হয়ে পড়েন রোমানা ও রিপন দম্পতি।
    বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা এর সহায়ক প্রকল্প ”জানো” এর মাধ্যমে সরকারের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষন নেয় তারা। এই প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সংসার আলোর মুখ দেখতে পায়। বসত ভিটার পাশে পতিত জমিতে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ শাকসবজী আবাদের পাশাপাশি, ছাগল, হাঁস-মুরগী পালন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ হয় তাদের। এখন তারা অনেকটাই স্বাবলম্বী। 
রোমানা দম্পতি এখন অন্যের জমি ইজারা নিয়ে আবাদ করেন আলু, ধান, গম, ভ’ট্টাসহ নানান ফসল। তাদের সন্তানেরা এখন স্কুলে যায়। জানো প্রকল্পের মাধ্যমে হাজারো নারী, গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, কিশোর-কিশোরী আগের চেয়ে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ ও সামাজিকভাবে সচেতন হয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারী, বেসরকারী সম্পদের ব্যবহার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন। পুষ্টিগুণসম্পন্ন ফসল উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে আয় বেড়েছে। 
 ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা এর সহায়ক প্রকল্প হিসেবে রংপুর ও নীলফামারী জেলার ডোমার, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ ও নীলফামারী সদর উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন এবং রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও তারাগঞ্জ উপজেলার ২০টি ইউনিয়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলতি বছর জুনে শেষ হচ্ছে এ প্রকল্পের মেয়াদ। 
”জানো” প্রকল্প পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি নিরসন, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারী এবং কিশোরীদের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতকরণে সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়ক প্রকল্প হিসাবে কাজ করে চলেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কিশোরীরা ক্ষমতায়িত হয়েছে। এর ফলে তারা পুষ্টি-সংবেদনশীল ও পুষ্টি নির্ভর সেবাগুলো সম্পর্কে জানতে পারছে এবং প্রয়োজনমত সেবা নিতে পারছে। 
তথ্য প্রযুক্তি এবং ই-সেবাদানকারী অ্যাপ বদল এনেছেঃ- মাঠ পর্যায়ে পুষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন রকম আইসিটি প্ল্যাটফরম ও ই-লার্নিং অ্যাপ তৈরি করেছে প্রকল্পটি। টকিং বুক, ডুকো ড্রামা এবং মোবাইল ফোনে নানা রকম সচেতনতা মূলক ক্ষুদে বার্তা সাধারন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টি ভিত্তিক তথ্য ও পরামর্শ সহজলভ্য করছে। এছাড়া ই-লানিং এবং ই-সেশন অ্যাপের মাধ্যমে একজন সেবাদানকারিকে পুষ্টি সংক্রান্ত সকল তথ্য জানাতে সহযোগিতা করছে। এর মাধ্যমে একজন মা এবং একজন স্কুলগামী কিশোরী তার ও তার পরিবারের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য নিজে জানতে পারছে এবং অন্যকে জানাতে পারছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য-পুষ্টি জ্ঞানে সমৃদ্ধ হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। বয়ঃসন্ধিকালে তাদের শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন ও করণীয় সম্পর্কে বুঝতে শিখেছে। খাবারের পিরামিড থেকে পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে করনীয় ও সুষম খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে ধারণা নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জেন্ডার সমতা নিয়ে নানা আলোচনা করছেন বিদ্যালয়ের জেমস শিক্ষকরা। কারাতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিশোরীরা হয়ে উঠেছে আত্মবিশ্বাসী। প্রশিক্ষিত বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরাও শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। 
পুষ্টি নিরাপত্তায় শিক্ষার্থীদের জলবায়ু সহিষ্ণ সবজি বাগানঃ- গঙ্গাচড়া সরকারী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের এক প্রান্তে এক শতক জমির উপর তৈরী করা হয়েছে সবজি বাগান। শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুম শেষ হওয়ায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা, টমেটোসহ অন্যান্য সবজি বাগান থেকে তোলা হয়েছে। সেখানে নিয়মিত বাগান পরিচর্যা করছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নবম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া মনি সহপাঠিদের সাথে এ বাগানের দেখভাল করে। সে জানায়, জানো প্রকল্পের মাধ্যমে পুষ্টিবাগান করতে শিক্ষার্থীরা উদ্বুদ্ধ হয়। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে জৈব সার ব্যবহার করে বাগানে ৬টি বেড তৈরী করা হয়। সেখানে কৃষি কর্মকর্তার কাছে পুষ্টিগুণ জেনে বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি লাগান শিক্ষার্থীরা। বেডের পাশাপাশি বাগানের বেড়ায় লতা জাতীয় পুঁই শাক, বরবটি, করলাসহ নানা সবজি লাগানো হয়। জৈব বালাইনাশাকের ব্যবহার সম্পর্কে জানাতে পারে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞান নিয়ে বিদ্যালয়ের মত বাড়িতেও সবজি বাগান গড়ে তুলেছে।
জানো প্রকল্পের কার্যক্রমঃ- জানো প্রকল্প রংপুর ও নীলফামারী জেলার ৬৫টি ইউনিয়ন জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে বার্ষিক পুষ্টি কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দ্বি-মাসিক সভার আয়োজন, জেলা-উপজেলা পুষ্টি সমন্বয় কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান, উপজেলা ও কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের (সিএসজি) বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা মিটিং, এবং সিএসজি পূর্ণগঠন, কৃষক প্রশিক্ষণ ও বসতভিটায় সবজি চাষ, স্কুল পর্যায়ে সবজি বাগান, দিবস উদযাপন, স্কুল ও মাদ্রাসায় জেন্ডার ইক্যুইটি মুভমেন্ট ইন স্কুল (জেমস) কার্যক্রম, উন্নয়নের জন্য নাটক (টিএফডি) দলের জন্য উপকরণ বিতরণ, স্কুল ও মাদ্রাসায় কিশোর-কিশোরী কর্ণার কার্যক্রম, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও ক্যাম্পোইন কার্যক্রম, করোনা ভাইরাস সচেতনতা নানা কার্যক্রম। 
জানো প্রকল্পের ফুড বেইজ নিউট্রেশন কনসালটেন্ট শফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচিত স্কুলে জানো প্রকল্প কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছে। কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের জানছে এবং তাদের শারীরিক-মানসিক পরিবর্তনে করণীয় নিয়ে অবগত হয়েছে। মেয়েরা তাদের আত্মরক্ষার কৌশল শিখেছে। স্কুল কেবিনেট কার্যক্রম সক্রিয় হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে। আইসিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষিত হয়ে তাদের পরিবারে জানাচ্ছে, তারা স্মার্ট হচ্ছে। আমরা মনেকরি জানো প্রকল্পের বাসÍবায়িত কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এসএমসি’র সদস্যরা স্কুল ভিজিট করছে, কিশোর-কিশোরী কর্নারে শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে, সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অর্ন্তভূক্ত করা হচ্ছে। এসব বিষয়গুলো পাশের স্কুলে, পরিবারে ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবে ধীরে ধীরে জানো প্রকল্পের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। 
নীলফামারী সিভিল সার্জন ডাঃ হাসিবুল ইসলাম বলেন, জানো প্রকল্পের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য-পুষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান ছড়িয়ে পড়েছে। তারা পুষ্টি বাগানের মাধ্যমে শাক-সবজি আবাদ এবং পরবর্তীতে তা খাওয়ার মাধ্যমে তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করছে। ফলে আগামীর প্রজন্ম মেধাবী, স্বাস্থ্যবান হয়ে বেড়ে উঠছে। যা আমাদের এসডিজি অর্জনে সহায়ক হবে। 

উল্লেখ যে, প্রকল্পটির শুরুতে কর্ম এলাকায় একটি বেজলাইন সার্ভে করা হয়। এসময় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের বৈচিত্র্যময় খাদ্য গ্রহনের অভ্যাস পাওয়া যায় ৩৪ দশমিক ৯ ভাগ। সেখান থেকে প্রকল্পটির মাধ্যমে ৪৬ দশমিক ৯ ভাগে উন্নিতির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। গত পাঁচ বছরে অর্জিত লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে হয়েছে ৫১ দশমিক ২ ভাগ। জানো প্রকল্প এর আওতাধীন সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী রয়েছে ৮ লাখ ৯৭ হাজার ৯২৩ জন। 

মন্তব্য করুন


 

Link copied