নাহিদা হাসান দীপা
প্রকৃতিকে কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে আবির্ভাব ঘটে শীতকালের।প্রকৃতিদেবীর নিয়ম অনুসারে রাতের অলসতা ত্যাগ করে কুয়াশার চাদর ভেদ করে আগমন ঘটে শীতের সকালের।প্রকৃতি যেন এক নতুন রূপ নেয়।আর এই প্রকৃতির সাথে গ্রামের মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শীতকাল তাদের জীবনে যেমন কষ্ট বয়ে আনে, তেমনি আনন্দ আর আমেজের নতুন এক অধ্যায়ও তৈরি করে। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা আর শীতল হাওয়ার মধ্যেও গ্রামীণ জীবনে যেন উৎসবের আমেজ কখনও ফুরায় না। বলছি উত্তরবঙ্গের গ্রাম এলাকার শীতের কথা। যেখানে শীতকালের ভয়াবহতা মানেই চোখের সামনে ভেসে আসে গ্রামীণ মানুষদের সেই অসহায় মুখ,সেই সাথে এক ফালি হাসি।
শীতকাল মানেই খেজুরের রস সংগ্রহের উৎসব আর সেটা যদি হয় উত্তরবঙ্গে তাহলে শীতকাল আরও বেশি করে তার রূপ ফিরে পায়। প্রত্যেক ভোরে খেজুর গাছ থেকে টাটকা রস সংগ্রহ করতে গ্রামের লোকেরা ভিড় জমায়। সেই রস দিয়ে তৈরি হয় গুঁড়, পাটালি, নলেন গুঁড়ের পায়েস ও হরেক রকম সুস্বাদু খাবার। এটি শুধু জীবিকার অংশ নয়, বরং গ্রামের মানুষের জন্য একপ্রকার শীতকালীন ঐতিহ্য। পিঠাপুলির উৎসবও শীতের আমেজ বাড়িয়ে দেয়। চালের গুঁড়া আর খেজুরের গুঁড় দিয়ে তৈরি হয় পিঠা, দুধ আর নারকেলের স্বাদে মিশে থাকে পরিবারের সবার ভালোবাসা। শীতের রাতে গোল হয়ে বসে পিঠা খাওয়ার আনন্দ যেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ গ্রামের মানুষই শীতের সকালে আলু কিংবা শীতকালীন সবজি তুলতে জমিতে কাজ করে। যদিও এই সময়ে শীতের প্রকোপের কারণে কাজ করাটা কঠিন, তবু মাঠে কাজ করার সময়ের আড্ডা আর গানে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তাছাড়া শীতকাল মানেই গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে বসে গান শোনা আর এর ফাঁকে গল্পের আসর জমানো। এমন সময়গুলো গ্রামীণ মানুষের কাছে এক অন্যরকম শান্তি আর আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকে।তবে এই রোমাঞ্চ আর আনন্দের বিপরীতে রয়েছে এক কঠিন বাস্তবতা। সমাজের একাংশ শীতকালকে এক কঠিন সময় হিসেবে দেখে। খোলা আকাশের নিচে থাকা মানুষদের জন্য শীতের রাত যেন এক দুঃস্বপ্ন। তাদের কাছে শীত কোনো আমেজ নিয়ে আসে না, বরং প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধকে আরও কঠিন করে তোলে।
তবু শীতকালের এই বৈচিত্র্য আমাদের শেখায় মানবতার দৃষ্টিতে জীবনকে দেখার গুরুত্ব। আমরা যদি একটু সচেতন হই, তবে আমাদের সামান্য উদ্যোগ অন্যের শীতের রাতকে একটু উষ্ণ করতে পারে। শীতের এই চেহারা—আমেজ আর সংগ্রাম—মিলে তৈরি করে জীবনকে আরও রঙিন। এভাবেই, হাড়কাঁপানো শীতেও শীতের আমেজ যেন শেষ হয়ে যায় না। আনন্দের সাথে দায়িত্বশীলতার মিশেলে শীত হয়ে ওঠে আরও অর্থবহ।শীতের কষ্ট যেমন বাস্তব, তেমনি গ্রামের মানুষের উদ্যম আর আনন্দের খোঁজ তাদের সেই কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করার এই ক্ষমতা গ্রামীণ সমাজের প্রকৃত শক্তি।শীতকাল মানে শুধু এক ঋতু নয়, এটি জীবনকে নতুন করে উপভোগ করার এক ঋতু।
যদি উত্তরবঙ্গের কথা চিন্তা করি তাহলে সেখানে শীত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা,পঞ্চগড়, নীলফামারী এই জায়গাগুলোতে শীত একটু বেশী পরিমাণে থাকে। উত্তরাঞ্চলে যখন ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আছে ,তখন খোলা আকাশের নিচে কিংবা জীর্ণ ঘরে থাকা মানুষদের রাত কাটানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।দরিদ্র মানুষের কাছে শীতবস্ত্রের অভাব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।একটি কম্বল বা শীতের কাপড়ের জন্য অনেকেই কষ্টে দিন পাড় করেন।শীতকালে ক্ষেতের কাজ করতে কৃষকদের হাড়কাঁপানো শীতে বের হতে হয়। শিশির ভেজা মাটিতে কাজ করা, গবাদি পশুর দেখাশোনা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।দিনের পর দিন ঠান্ডা সইতে গিয়ে অনেকে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।শীতকালে ঠান্ডা,সর্দি, কাশি,নিউমোনিয়া ও শ্বাস কষ্টজনিত রোগের প্রকোপ গ্রামীণ এলাকায় বেড়ে যায়।সঠিক চিকিৎসার অভাবে তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তোলে।শিশু ও বয়স্করা এই সময় বেশি ভোগান্তির শিকার হন।
শীতের চ্যালেঞ্জগুলো থাকা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষের মুখে হাসি ধরে রাখার মূল রহস্য তাদের সরলতা, ইতিবাচক মনোভাব এবং পারস্পরিক ভালোবাসা। তাদের এই উদাহরণ আমাদের শেখায় কষ্টেও কিভাবে জীবনের রং খুঁজে পাওয়া সম্ভব। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের তেমন কোনো সমস্যা নেই। তারা মূলত শীতকে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু নিম্নবিত্ত এবং সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এই শীত এক ভয়াবহ দুর্ভোগ নিয়ে আসে।বিশেষ করে গৃহহীন মানুষ, পথশিশুদের কষ্টের কোনো সীমা থাকে না। তাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা নেই বললেই চলে। পথশিশুরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামা এই বিপুল সংখ্যক শিশুরা উপেক্ষার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শীতকালে তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।শীত আমাদের জীবন যেমন আশীর্বাদ তেমনি অভিশাপও বটে। অপরূপ শীতের সৌন্দর্য অনুভবে ও উপভোগে আমরা ভুলে যাই সেইসব ছিন্নমূল মানুষের কথা। এক টুকরো শীতের কাপড় বা মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই যাদের, তাদের জীবনে শীত আনন্দ নয় বরং অভিশাপ।শীতের অভিশাপ থেকে শীতার্ত মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব প্রথমত দেশের শাসকদের উপর। এরপর সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
গুটি গুটি পায়ে প্রত্যেক বছর যেমন শীতের আগমন ঘটে তেমনি গ্রামের মানুষদের বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কিছু কিছু গ্রামে কষ্টের সীমা থাকেনা ।কিন্তু তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়না।তবু শীতের এই কষ্ট ভুলে থাকতে আমেজে মেতে থাকে আমাদের গ্রামীণ মানুষ। তাদের সরলতা ও সজীবতা যেন হার মানায় সবকিছুকে। আমাদের সামান্য সহানুভূতি ও ভালো উদ্যোগই পারে তাদের জীবনটাকে আরও সহজ, সুন্দর ও উপভোগ্য করে তুলতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।