জান্নাতুল সাদিয়া
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের একজন অনন্য রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, সাধীনতা সংগ্রামী। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার জীবন চলাকালে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলার নিপীড়িত, বঞ্চিত এবং শোষিত মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ১৮৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া অঞ্চলে তাঁর জন্ম।বাল্যকালে পরিবারের সকলকে হারানোর পর তিনি কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে ছিলেন।তিনি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ যান,১৯০৯ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় টাঙ্গাইলে কাগমারী স্কুলে শিক্ষকতার মধ্যে দিয়ে।
১৯১০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত বাংলা এবং আসামের কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে। তিনি কংগ্রেস নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন ও ১৯১৯ সালে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য হন। আসামের ভাসানচরে কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করে কৃষকদের উপর অত্যাচার নিয়ে প্রতিবাদ জানান, সেখানেই তিনি "ভাসানী " উপাধি পান ১৯২৯ সালে।১৯৩৭ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে গ্রেফতার হন,পরের বছর তিনি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল "আওয়ামী লীগ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ভাসানী কিন্তু একটা সময় পর সেই দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়,সেটার পিছনে রয়েছে অনেক কারণ। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আওয়ামী লীগই ভাসানীকে নিয়ে খুব একটা চর্চা করেনি,
সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ভাসানী এখনও অনেকটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
১৯৪৭ এ সদ্য পাকিস্তান পরিচয় পাওয়া একটা জাতি দুই বছরের মাথায় অনুভব করেছে মুসলিম লীগের রক্ষণশীল রাজনীতি দিয়ে এই অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে ' পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠিত হয় এবং সর্বসম্মতি ক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ভাসানী তখনকার ৫টি বিরোধী দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এ জোটের অপরাপর নেতা ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ১৯৫৪ সালের অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন।আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির দ্বন্দ্বের কারণে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়।
পরবর্তীতে, ১৯৫৫-৫৭ এর মধ্যে আওয়ামী লীগ এর সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মত-পার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে এই রাজনৈতিক দলটিতে ভাঙন দেখা দেয়।তখনকার সময়ে "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ" ছিল পাকিস্তান সরকারের, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের কয়েকটি সামরিক চুক্তি হয়। সিয়াটো এবং সেন্টো সামরিক জোটে পাকিস্তান সদস্য ছিল।মওলানা ভাসানী এবং দলের মধ্যে থাকা বামপন্থীরা চাপ দিচ্ছিলেন যাতে আওয়ামী লীগ মার্কিন সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসে। সোহরাওয়াদী ছিলেন মার্কিন চুক্তির সমর্থক।পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি করছিলেন মওলানা ভাসানী, কিন্তু তাতে রাজি হননি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী।ওই বিরোধের একটা পর্যায়ে এসে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে দলের যে সম্মেলন হয়, সেখানে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে হেরে যায়। এরপর ১৯৫৭ সালের ১৮ই মার্চ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী।
১৯৪৭ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে, আওয়ামী লীগ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন,৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৭৬ সালে ফারাক্কা লং মার্চ এর লিডার এসব অবদানের বিপরীতে কতটুকু মর্যাদা পেয়েছে উনি সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। গত ১৫ বছর ভাসানীকে নিয়ে কেন চর্চা হয় নি?কেন তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয় নি? বিগত সরকার দেশের ইতিহাসে আদর্শ রাজনীতিবিদ বলতে শেখ মুজিব কেই বুঝিয়েছেন। বলা হয় ৭৫ -এ পরিবারসহ অ্যাসাসিনেটেড হওয়ার পর মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন। এ কারণে ক্ষমতা হারানো দলটির কাছে যথোচিত সম্মান ও মর্যাদা ভাসানী পাননি। তাদের দিক থেকে একমাত্র বঙ্গবন্ধুকেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষ বানিয়ে বাকি বীরদেরকে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। ৭১ এর ৭ই মার্চ এর ঘোষণার পর যে ৯ মার্চ মওলানা ভাসানী ভাষণ দিয়েছিলেন সে ইতিহাস আমরা কোথাও পাইনা। তবে বর্তমানে দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীই মওলানা ভাসানীর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং মর্যাদা প্রকাশ করছেন।
সবশেষে, দৃঢ় ভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসের আলোচনায় মওলানা ভাসানী নিশ্চিতই অনিবার্য উচ্চারিত নাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।