কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামের চিলমারী-রৌমারী নৌ রুটে ব্রহ্মপুত্র নদে সারা বছর ড্রেজিংয়ের কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। একদিকে নাব্যতা সংকট যেমন কাটছে না, অন্যদিকে ড্রেজিংয়ের নামে সরকারকে লাখ-লাখ টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্যতা সংকট নিরসনের জন্য গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিসি’র সে সময়কার চেয়ারম্যান ড. একেএম মতিউর রহমান নদ খননের তাগিদ দিলেও কর্ণপাত করেনি বিআইডব্লিউটিএ।
স্থানীয়রা বলছেন, নাব্যতা সংকট কাটাতে ব্যর্থ বিআইডব্লিউটিএ। নদী ড্রেজিংয়ে গাফিলতি এবং নৌকার মালিকদের সঙ্গে সিন্ডিকেটের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের ফেরি আলোর মুখ দেখছে না। এতে চিলমারী-রৌমারী নৌ রুটে যাতায়াতকারী মানুষ ও পরিবহন চালকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, চিলমারীর রমনা ঘাট থেকে রৌমারীর ফলুয়ার চর ঘাটের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। এই ২২ কিলোমিটার নদী পথ পাড়ি দিতে নানা সংগ্রাম করতে হয় এ অঞ্চলের মানুষদের। কখনও চর হেঁটে বা কখনও নৌ পথে। দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চিলমারী-রৌমারী নৌ রুটে ফেরি চলাচল শুরু হয়। ফেরি চলাচলের ফলে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ জনভোগান্তি কিছুটা কমলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নাব্যতা সংকটের অজুহাত দেখিয়ে বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে ফেরি চলাচল। ফলে বাড়তি ভাড়াসহ নানা ভোগান্তির মধ্যে নৌকায় পারাপার করতে হচ্ছে দুই পারের মানুষদের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চিলমারী-রৌমারী নৌ রুটে দারুণ সম্ভাবনায় একটি ফেরি সার্ভিস। এই ফেরির মাধ্যমে অনৈতিকভাবে চাঙা হবে এ অঞ্চল। তবে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটি’র সঙ্গে নৌকার মালিকদের যোগসাজস রয়েছে। ফলে রহস্যজনক কারণে কচ্ছপ গতিতে তারা নদী ড্রেজিংয়ের কাজ করছেন। অপরিকল্পিত নদী খনন আর ধীরগতির কারণে সুযোগ নিচ্ছে নৌকার মালিকরা। ফলে বাড়তি ভোগান্তির সঙ্গে পকেট ফাকা হচ্ছে নদী পারাপারকারী মানুষজনের। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর থেকে নদীতে নাব্যতার সংকট ও ড্রেজিংয়ের কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখে বিআইডব্লিটিএ। যা গত দেড় মাসেও এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা।
এদিকে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় প্রায় প্রতি মাসে ১২ লাখ ৩০ হাজার টাকা গচ্ছা দিচ্ছে বিআইডব্লিউটিসি বলে জানা গেছে। পাশাপাশি ফেরি বন্ধ থাকায় ফেরির ইঞ্চিন ক্ষতির মুখে পড়ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ঘাটের দুই পারে হাই ওয়াটার ও লো ওয়াটার ঘাট নেই। স্থায়ীভাবে ড্রেজার মেশিন না থাকায় ড্রেজিং ব্যবস্থা না থাকায় বারবার ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নাইট নেভিগেশন (বাতি) ব্যবস্থা চালু না থাকায় রাতের বেলা ফেরি চলা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দীর্ঘদিনেও আলোর মুখ দেখছে না চিলমারী-রৌমারী রুটে ফেরি চলাচল।
সরেজমিনে আলম মিয়া, শাহাজামাল হোসেন, তোফাজ্জল হোসেনসহ কয়েকজন নৌকার যাত্রির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘ফেরি চালু হওয়ায় অনেক সুবিধা হতো। কিন্তু নৌকায় তো বড় সিন্ডিকেট, একটা মোটরসাইকেল তুলতে নেয় ৬০ টাকা, নামাতে ৬০টাকা এবং মোটরসাইকেলের ভাড়া ১০০ টাকা। এ ছাড়া জনপ্রতি ১০০টাকা ভাড়া। এতো টাকা ভাড়া যেটা আমাদের পক্ষে বহন করা খুবই কষ্টের। ফেরি থাকলে সেটা ১০০ টাকাতেই হতো।’
রংপুরের বাসচালক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, ‘সামান্য রাস্তা সংযোজন করে চিলমারী ফেরি ঘাটটি যদি ফকিরেরহাটে স্থানান্তর করা হয় তাহলে দূরত্ব কমে যাবে। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের অনেক বাস পরিবহন মালিক এই রুটে বাস পারাপার করতে আগ্রহী। এক্ষেত্রে দূরত্ব কম হলে এবং নেভিগেশনের (রাতে বাতি)ব্যবস্থার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সার্ভিস চালু রাখলে গাড়ি পারাপারে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।’
ভূরুঙ্গামারীর সোনাহাট স্থলবন্দরের ট্রাকচালক হাসান আলী জানান, গত বছর বন্যার আগে নেভিগেশন (বাতি) ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্ত বন্যার সময় বাতি তুলে ফেলা হয়। পরবর্তীতে আর স্থাপন করা হয়নি। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে তিনটার পর ফেরিগুলো লোড নেওয়া হয় না। দেখা যেত কিছু গাড়ি দেরিতে পৌঁছলে সে ক্ষেত্রে গাড়িগুলো সারা রাত অপেক্ষা করে পরেরদিন পারাপার করতে হতো। নেভিগেশন ব্যবস্থা থাকলে রাতে গাড়ি পারাপারের সংখ্যা বহুগুন বেড়ে যাবে।’
এ অবস্থায় চিলমারী-রৌমারী নৌ রুটে নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন ফেরি চলাচল অব্যাহত রাখতে ড্রেজিং করণ, উভয় প্রান্তে লো-ওয়াটার ঘাট ও অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ, রাত্রিকালীন বাতি স্থাপন করলে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হলে এ অঞ্চলে অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন অনেকে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) চিলমারীর ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) প্রফুল্ল চৌহান বলেন, গত ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ থেকে ফেরি কদম ও কুঞ্জলতা বন্ধ রয়েছে। এতে করে বাড়তি বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে পরিবহন ও যাত্রীদের। দ্রুত ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হলে এ ভোগান্তি নিরসন করা সম্ভব হবে।
বিআইডব্লিউটিএ’র দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের পাঁচটি ড্রেজারের মধ্যে তিনটি ড্রেজার দিয়ে খননকাজ অব্যাহত রয়েছে। একদিকে খনন করলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তবে কবে নাগাদ ফেরি চালু হবে এ বিষয়ে নিদিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।’
বিআইডব্লিউটিএ’র উপপরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হলে নাইট নেভিগেশনের (বাতি) ব্যবস্থা চালু করা হবে।