স্টাফ রিপোর্টার,নীলফামারী॥ তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়নে তিস্তা নদী বেষ্টিত উত্তরের জেলা নীলফামারীর অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা পাওয়ার চায়না। বুধবার (১২ মার্চ) সকাল ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত নীলফামারী জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে তিস্তাপাড়ের মানুষ, তিস্তা নদীরক্ষা আন্দোলনকারী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকসহ অংশীজনদের অংশগ্রহণে ‘তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনঃরুদ্ধার প্রকল্প’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মতবিনিময় সভায় প্রকল্পের ওপর তথ্যচিত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়নার (পাওয়ার চায়নার) পরামর্শক ও পাউবোর সাবেক অতিরিক্ত প্রকৌশলী মকবুল হোসেন বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার আমুল পরিবর্তন ঘটবে। তিনি জানান, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে কাজ শুরু থেকে পরবর্তী সময় লাগবে ৫ বছর। তিস্তা নদীর প্রবেশদ্বার নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারাজের উজানে এ জন্য ৭ কিলোমিটার জলধার তৈরী করা হবে।
উক্ত সভার সভাপতিত্ব করেন নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান।
মতবিনিময় সভায় পাওয়ার চায়নার প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি ম্যানেজার হান কুন বলেন, আমরা এমন এক সময় তিস্তা নদীতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এসেছি যখন এখানকার মানুষ জমিভিটা স¤পদ হারিয়েছে। এজন্য আমরা শুনতে এসেছি এখানকার মানুষের কথা। তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প তিস্তাপাড়ের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এবং এটি ভূ-রাজনৈতিক প্রোপটে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিস্তা মহাপরিকল্পনা একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প তাই এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো স¤পর্ক নেই। যে প্রকল্পে মানুষের উপকার হয়, সে প্রকল্পে ভূরাজনৈতিক প্রোপট গৌণ এবং এ প্রকল্প পরিবেশে জন্য তিকর হবে না। তিনি বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তিস্তাপাড়ের মানুষের আবাদি জমি পুনরুদ্ধার হবে এবং তারা এসব জমিতে ফসল ফলিয়ে শান্তিতে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।
সভায় স্বাগত বক্তব্যে পাউবোর উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান বলেন, তিস্তা পরিকল্পনায় আর যাতে কোনো ফাঁক না থাকে। সে জন্য মতামতের ভিত্তিতে যাতে এ প্রকল্প নেওয়া যায়, এই কারণে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় গ্রোয়েন নির্মাণ এবং তীর প্রতিরক্ষা কাজের মাধ্যমে নদী ভাঙ্গণরোধ, বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজের মাধ্যমে বন্যা ঝুঁকি হ্রাস, ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও নদী পুনরুদ্ধার, ড্রেজিং এর মাধ্যমে শাখা নদীগুলোর নাব্যতা রক্ষাসহ নদী সমুহে শুষ্ক মৌষুমে পানি সংরক্ষণ পুর্বক প্রকল্প এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।
এই সরকারের সময়েই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরুর দাবী জানিয়েছেন বিভিন্ন অংশীজন। তারা বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার দাবি আমাদের অনেক আগেই ছিল। এটি বাস্তবায়ন অতি জরুরী। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের ওই প্রকল্পের নতুন করে আলোচনা ও জরিপ করা দরকার ছিল। এটা আমরা পেলাম না। আমরা চাই এ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হোক। শিল্প প্রতিষ্ঠিত হোক, মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হোক। তারা আরো বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কেউ যাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে সেদিকে নজরদারী করতে হবে। যেভাবেই হউক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই হবে। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিস্তাপাড়ের মানুষজনের জমির যে ক্ষতি হবে তার ক্ষতি পূরণ প্রদানের বিষয়টি প্রকল্পে সংযুক্ত করার দাবি করেন তারা।
সভায় তিস্তাপাড়ের অংশিজন ছাড়াও বক্তব্য রাখেন, জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সাত্তার, জেলা বিএনপির সাধারণ স¤পাদক জহুরুল আলম, জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মূখ্য সংগঠক আবু সাঈদ লিওন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নদীসংগঠক রিভাইন পিপল এর পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম স¤পাদক ফরিদুল ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কনক রহমান, জেলা আদালতের জিপি আবু মো. সোয়েম ও পিপি আল মাসুদ চৌধুরী প্রমুখ।
সমাপনী বক্তব্যে সভাার সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামাস জানান, তিস্তা নিয়ে সম্ভাব্য সমীাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। সেখান থেকে যে কেউ পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত দিতে পারবেন। তিস্তাপারের মানুষ কীভাবে উপকার পেতে পারেন, সে জন্য এই মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ) আবদুস সামাদ শিকদারের সঞ্চালনায় সভায় সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুর রহমান, ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি রাহেদুল ইসলাম দোলন, সাংগঠনিক সম্পাদক শেফাউল জাহাঙ্গীল আলম সেপু, ডিমলা উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ মনোয়ার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক রব্বানী প্রধান, জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি নুর আলম, বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ যে, এর অংশ হিসেবে নীলফামারীর পূর্বে গত ৯ মার্চ গাইবান্ধা, ১০ মার্চ রংপুরে ও ১১ মার্চ লালমনিরহাটে মতবিনিময় করেন পাওয়ার চায়না কো¤পানি। আগামীকাল ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রামে মতবিনিময় সভার মাধ্যমে তিস্তাপাড়ের ৫ জেলার মতবিনিময় সভা শেষ হবে।
এবিষয়ে পাউবোর উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন. ৫ জেলার তিস্তাপাড়ের মানুষজনের মতামত নেয়া শেষ হলে পূর্বের জরিপের সাথে সংযোজন বিযোজন করে মাঠ পর্যায়ে জরিপ পরিচালনা করবে চায়না পাওয়ার। এরপর চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বর্তমান অন্তবর্তীকালিন সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সরকারের অনুমোদনক্রমে ‘চায়না পাওয়ার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে’। তিনি আরো জানান, প্রকল্প শেষ হলে তিস্তার নদীর ৫ জেলায় নদী ভাঙ্গন রোধ হবে, বন্যা ঝুঁকি গ্রাস পাবে, নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রন হবে, সেচ ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে ও বর্ষাকালের পানি নদীতে সংরক্ষন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে।
প্রকাশ থাকে যে- এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তাপাড়ে বিশেষ গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তিস্তা অববাহিকার পাঁচ জেলার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারই আলোকে ৫ জেলায় এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।