আর্কাইভ  সোমবার ● ৩১ মার্চ ২০২৫ ● ১৭ চৈত্র ১৪৩১
আর্কাইভ   সোমবার ● ৩১ মার্চ ২০২৫
শুভেচ্ছাবার্তা:
উত্তর বাংলা ডটকম পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক ।
শতাধিক গাড়ির বহর:

জারার প্রশ্ন, জবাবে ‘দাদার সম্পত্তি’ দেখালেন সারজিস

বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, সকাল ০৫:১৮

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: “নতুন বন্দোবস্ত বলতে আমরা যেটা কল্পনা করি সেটা ছয় মাসের মধ্যে ‘এপ্লাই’ করলে ‘অলমোস্ট’ ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জামানত হারানোর সম্ভাবনা থাকবে,” লিখেছেন সারজিস। 

জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নেতা সারজিস আলমের শতাধিক গাড়ির বিরাট বহর নিয়ে পঞ্চগড়ে রাজনৈতিক ‘শো ডাউন’ দেওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন তুলেছেন দলে তার সতীর্থ তাসনিম জারা।

সারজিস এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) এবং তাসনিম জারা দলটির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নিজের ফেইসবুক পেইজে সারজিসের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন পেশায় চিকিৎসক, গবেষক ও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার তাসনিম জারা।

তার প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাতে তাসনিম জারার খোলা চিঠির জবাবে সারজিস আলম বলেছেন, তার দাদা যে সম্পত্তি তার জন্য রেখে গেছেন তাই দিয়েই তিনি নির্বাচন করতে পারবেন।

সারজিসের উদ্দেশে জারা তার খোলা চিঠিতে লিখেছেন, “প্রিয় সারজিস, আমি এই চিঠিটি লিখছি আমাদের দলের একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, দলের নীতিগত অবস্থান ও স্বচ্ছতার প্রশ্ন থেকে। সম্প্রতি তোমার নিজ জেলায় শতাধিক গাড়ির একটি বড় বহর নিয়ে প্রবেশ করায় জনগণের মনে যৌক্তিকভাবেই কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।”

গত ৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সেই আন্দোলনের সাত মাস পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে গঠিত হয় এনসিপি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সারজিসের কাছে ‘কোনো টাকা নেই’, কিছুদিন আগে তার দেওয়া বক্তব্যের সূত্র ধরে জারা লিখেছেন, “তুমি কিছুদিন আগেই প্রকাশ্যে বলেছিলে, ‘আমার আসলে এই মুহূর্তে কোন টাকা নাই। ধার করে চলতেছি। এইটাই হচ্ছে রিয়্যালিটি। আমার পকেটে মানিব্যাগও নেই।’ তোমার এই সাদাসিধে জীবনযাত্রার কথা আমাদের অভিভূত করেছিল এবং জনগণের কাছে আমাদের সংগ্রামকে আরও গ্রহণযোগ্য করেছে।

“কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটে এত বড় একটি আয়োজন কীভাবে সম্ভব হলো— এর অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে হয়েছে, তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। আমাদের দল স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে জায়গা থেকে এসব প্রশ্নের স্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য উত্তর দেওয়া আমাদের সবারই দায়িত্ব।

“আমি আশা করি, বিষয়টি তুমি আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা করবে এবং জনগণের সামনে একটি গ্রহণযোগ্য ও পরিষ্কার ব্যাখ্যা তুলে ধরবে। এতে জনগণের কাছে দলের ভাবমূর্তি আরও শক্তিশালী হবে বলেই আমার বিশ্বাস।”

“শুভেচ্ছান্তে, জারা আপু”- লিখে চিঠিটির ইতি টেনেছেন তিনি।

তার আগে সোমবার ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে সৈয়দপুর যান সারজিস। সেখানে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এরপর তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরের পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি।

তার গাড়িহরের যে ভিডিও প্রকাশ হয়েছে তাতে দেখা যায়, বিকালের দিকে শতাধিক গাড়ির বিরাট বহর নিয়ে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলায় ঢুকছেন সার্জিস। আটোয়ারী তার নিজ উপজেলা।

বহরের সবার সামনে একটি কালো রঙের আলফার্ড মাইক্রোবাসে ছিলেন সারজিস। গাড়ির সানরুফ খুলে দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশে হাত নাড়তে যেতে দেখা যায় তাকে। তার বহরে শতাধিক গাড়ি থাকলেও গাড়িগুলোর বেশিরভাগই পুরোপুরি ভরা ছিল না। কোনো কোনো গাড়িতে চালকসহ দুই থেকে তিনজনকে দেখার কথা বলেছেন স্থানীয়রা।

জারার প্রশ্নে ‘দাদার সম্পত্তি’ দেখালেন সারজিস

নিজের ফেইসবুক পেইজে জারার প্রশ্নের জবাব দিয়ে পোস্ট করা পাল্টা খোলা চিঠিতে এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, নতুন বন্দোবস্ত বলতে তারা যেটা ভাবছেন সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে গেলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জামানত হারানোর সম্ভাবনা থাকবে। সেই ক্ষেত্রে তিনি নতুন বন্দোবস্তের সঙ্গে পুরনোর মিশেলের ‘যথার্থতা’ দেখছেন। তার শত গাড়ির বহরের সমালোচনাকারীদের ‘কতিপয় সোশ্যাল মিডিয়া বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

একই চিঠিতে সারজিস স্বীকার করে নিয়েছেন, নতুন বন্দোবস্তেও একটা অংশ ‘চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, মামলা বাণিজ্য, হয়রানি’ করে যাচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে তারা ‘টু শব্দটিও’ করতে পারছেন না।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের জনগণের মানসিকতা নিয়েও। বলেছেন, এলাকার মানুষ নেতার কাছে ‘তদ্বির’ নিয়ে আসবেই, ‘অনৈতিক তদ্বির’ রক্ষা না করলেও গিয়ে ‘বিরুদ্ধাচরণ’ করবে।

চিঠিতে ‘প্রিয় তাসনিম জারা আপু’ সম্বোধন করে সারজিস লিখেছেন, “আপনার খোলা চিঠির উত্তরের পূর্বে দুটি বিষয় বলতে চাই। প্রথমত, আমাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা থেকে সবার আগে যে বিষয়টি বাদ দিতে হবে সেটি হচ্ছে- একজন নতুন করে জাতীয় রাজনীতিতে এসেছে মানেই তার পরিবার সহায়-সম্বলহীন, অসহায়, নিঃস্ব না।

“বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতারা চাঁদাবাজি, লুটপাট করে এসব কাজ করেছে বলে, একই কাজ করে অন্যরাও সেটা করবে বিষয়টি তেমনও নয়। আমার এই মুহূর্তে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই মানে এই নয় যে আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের সেই সামর্থ্য নেই।

“দ্বিতীয়তঃ কতিপয় সোশ্যাল মিডিয়া বুদ্ধিজীবী তাদের জায়গা থেকে যেভাবে রাজনীতিকে কল্পনা করেন সেটা কোনো আদর্শ পৃথিবীর চিত্র হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো বৈচিত্র্যময় চিন্তাধারা ধারণকারী জনগণ সম্বলিত একটি দেশের এই মুহূর্তের চিত্র নয়। এমনকি বাংলাদেশের একটি জেলার রাজনৈতিক ‘কালচারের’ সাথে অন্য একটি জেলার রাজনৈতিক ‘কালচারেরও’ পুরোপুরি মিল নেই।

“তাই আমার চোখের সামনে আমার আসনে যা দেখছি সেটা দিয়ে অন্য আসনেও তুলনা করা যায় না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দলগত অবস্থান বিবেচনায় সেই ‘ইকুয়েশনগুলো’ ভিন্ন হয়।”

সারজিস লিখেছেন, “আমরা নতুন বন্দোবস্ত চাই। কিন্তু নতুন বন্দোবস্ত বলতে আমরা যেটা কল্পনা করি সেটা ছয় মাসের মধ্যে ‘এপ্লাই’ করলে ‘অলমোস্ট’ ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জামানত হারানোর সম্ভাবনা থাকবে। তার মানে কি আমরা নতুন বন্দোবস্ত চাই না? অবশ্যই চাই। কিন্তু সেটা কখনো ছয় মাসের ব্যবধানে ১৮০ ডিগ্রি উল্টে যাবে না বরং সময়ের সাথে সাথে ১০, ২০, ৩০ শতাংশ- এভাবে পরিবর্তিত হবে। এক সময় হয়তো শতভাগ নতুন বন্দোবস্ত দেখতে পাব।”

তিনি লিখেছেন “‘ফেসবুকের রাজনীতি’ আর মাঠের রাজনীতি এক নয়। আপনার প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করার জনবল এবং সামর্থ্য আপনার যদি না থাকে কিংবা আপনি দেখাতে না পারেন তাহলে মাঠের রাজনীতিতে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। অন্য নেতা তো দূরের কথা সাধারণ জনগণও আপনাকে গোনায় ধরবে না। কারণ মানুষ স্বভাবতই ক্ষমতামুখী।

“আমাদের যেমন নতুন বন্দোবস্তের দিকে যেতে হবে তেমনি মাঠের রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য পূর্বের যেই বন্দোবস্তগুলো চাইলেই এখনই ছুঁড়ে ফেলা সম্ভব নয় সেগুলোকেও পাশে রেখে আপাতত চলতে হবে। যেদিন সেগুলোও ছুঁড়ে ফেলার সুযোগ আসবে সেদিন সেগুলোর ছুড়ে ফেলতে হবে।”

সমালোচনাকারীদের ‘বুদ্ধিজীবি’ তকমা দিয়ে সারজিস বলেছেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক বুদ্ধিজীবী তাদের যে আইডিয়াগুলোকে বিভিন্ন ‘ন্যারেটিভ দিয়ে স্টাবলিশ’ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দেখায়, তারা সেই ‘প্রসেসে’ বাংলাদেশের এই মানসিকতার জনগণের কাছে- এই ইলেকশনে মাঠে নামলেও জামানত হারাবে, একই ‘প্রসেসে’ ৫ বছর পরে ইলেকশন করলেও জামানত হারাবে।

“তারা শুধু আপনার পিছেই ‘লাগতে পারে’ কিন্তু কোন ‘প্রসেসে’ আপনি মাঠে ইলেকশন করে জিতে আসতে পারবেন সেগুলো আপনাকে দেখাতে পারে না, কিংবা দেখালেও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর মাঠের বাস্তবতা নেই।”

সারজিস তার খোলা চিঠিতে লিখেছেন, “আমরা তো অনেকেই চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, মামলা বাণিজ্য, হয়রানি এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেললাম। কিন্তু এই অভ্যুত্থানেরই একটি অংশ আবার ওই একই কাজগুলো করছে। আটকাতে পেরেছেন কি? পারেননি।

“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আপনারা অনেকে কথাও বলতে পারছি না। আর বললেও তারা সে কথাকে কানে নেয় না। কথা বলতে পারছি সেই অল্প কিছু নতুন করে চিন্তা করা মানুষের বিরুদ্ধে যারা এখনো সেই কথা বলার স্পেসটা দেয় এবং সেই কথাগুলোকে রিসিভ করে।”

মানুষ শুধু রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নিজের স্বার্থটা নিয়েই আসে তুলে ধরে এনসিপির এই নেতা লিখেছেন, “এবার কিছু তিক্ত কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ‘কালচার’ পরিবর্তন করতে হবে। এটা আবশ্যক। কিন্তু যতদিন না আমজনতা তাদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করছে ততদিন আপনি সরাসরি নতুন চিন্তাগুলোকে বাস্তবায়ন করতে গেলে সময়ের সাথে সাথে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন।

“আপনি আজকে একটি আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিন। কাল থেকে সেই আসনের অসংখ্য মানুষ আপনার কাছে আসবে নানা তদবির নিয়ে, আবদার নিয়ে। এর মধ্যে অনেক অনৈতিক চাওয়া থাকবে। আবার যাদের আবদার পূরণ করতে পারবেন না তারা আপনার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করবে। অথচ তারা একটিবারও ভাববে না আপনার সেই সামর্থ্য আছে কিনা, বিষয়গুলো ন্যায় সঙ্গত কিনা। তারা শুধু নিজের স্বার্থটা ভাববে। আপনি দিলে আছে, না দিলে নাই।

“তার উপর এখন আপনার কোনো ‘অথরিটিও’ নাই। এক্ষেত্রে সরাসরি নতুন বন্দোবস্ত ‘এপ্লাই’ করে দীর্ঘ মেয়াদে অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার চেয়ে সাময়িকভাবে নতুন পুরনো মিশেলে এগিয়ে গিয়ে যদি আপনি একটি ‘অথরিটি’ পান কিংবা নির্বাচিত হতে পারেন তখন বরং দীর্ঘমেয়াদে নতুন বন্দোবস্তের ‘কালচার’ চালু করা এবং সেগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার সুযোগ বেশি থাকবে। আমি এটাকে মন্দের ভালো মনে করি।”

গাড়ি বহরের অর্ধেক গাড়ি এলাকার মানুষ নিজেদের উদ্যোগে নিয়ে গেছেন দাবি করে সারজিস লিখেছেন, “আর আমার এলাকায় ফেরার সময় এত গাড়ি, এত মানুষ; তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং ভালোবাসা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে এবং আমাকে সঙ্গ দিবে এটা আমিও কল্পনা করিনি। আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং জেলার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্ধেকের বেশি গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। যেগুলোর ব্যয় আমাদের বহন করতে হয়নি।

“বাকি প্রায় ৫০টার মতো গাড়ির ৬০০০ করে যে তিন লাখ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে সে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার পরিবারের আরো ৫০ বছর আগেও ছিল। এবং আমি বিশ্বাস করি অন্য কেউ না; শুধু আমার দাদা আমার জন্য যতটুকু রেখে গিয়েছেন, সেটা দিয়ে আমি আমার ইলেকশনও করে ফেলতে পারব ইনশাআল্লাহ। ধন্যবাদ।”

মন্তব্য করুন


Link copied