লালমনিরহাট প্রতিনিধি : চলতি বছর সার, বীজ, সেচ ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বোরো আবাদে লালমনিরহাটের কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সেচনির্ভর বোরো চাষে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে বাড়তি উৎপাদন খরচে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এছাড়া বেড়েছে সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরিও। ফলে কৃষককে বোরো চাষে গুনতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও ধান বিক্রি করে খরচ তুলতে পারবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষকদের মাঝে।
কৃষকরা বলছেন, কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি না হওয়ায় প্রতিদিন পানি দিতে হচ্ছে, এতে সেচের খরচ বেড়েছে। মৌসুম শেষে ধানের বাড়তি দাম না পেলে তাঁদের উৎপাদন খরচ উঠবে না। এবার লালমনিরহাটের বোরো ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানান তারা। হাটে-হাটে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র খুলে ধান-চালের দাম বাড়িয়ে সংগ্রহ অভিযান পরিচালনার দাবি করছেন কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে লালমনিরহাটে বোরো আবাদ হয়েছে ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আগাম জাতের ধান কাটা- মাড়াই শুরু হবে।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন গিয়ে দেখা যায়, কৃষকেরা বোরো ধান খেত পরিচর্যা করছে। কিছু দিনের মধ্যে নতুন ধান বাড়িতে আসবে। অনেকে ধান খেত নিড়ানি দিচ্ছে, এ সময় শ্রমিক সংকট রয়েছে, মজুরিও বেশি।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বোরো মৌসুমে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল প্রায় ১২ হাজার ৫০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৮ হাজারেরও বেশি। গত বোরো মওসুমে প্রতি বিঘা জমিতে সেচের খরচ ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। প্রতি কেজি বীজ ছিল ২০০ টাকা, এবার তা হয়েছে ৩৫০ টাকা। এ ছাড়া সার খরচ ২ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। একই সঙ্গে কীটনাশক ৬০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার টাকা, ধান রোপণের মজুরি ৬০০ থেকে বেড়ে ৮০০- ১ হাজার হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা।
কাকিনা চাঁপারতল এলাকার আহেদুল ইসলাম বলেন, মজুরি বেশি তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়েই ধানের জমি পরিচর্যা করছি। বোরো ধান চাষাবাদের সঙ্গে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। আর তাই ধান উৎপাদনেও খরচ বাড়ছে। ডিজেলের দাম বেশি, একদিন পর পর পানি দেয়া লাগে জমিতে। সার দেয়া লাগতেছে ঘন ঘন। এমনটা হইলে আমরা কি বাঁচবো।’
একই এলাকার বর্গাচাষি বাবলু মিয়া বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর বোরো ধান চাষাবাদে খরচ অনেক বেশি পড়ছে। গত বছর প্রতি ঘণ্টায় সেচের পানি নিতে খরচ পড়ত ১৫০-১৬০ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ঘণ্টাপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা। এ ছাড়া সার সংকট ও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে, কীটনাশক ও বীজের দামও বেড়েছে। এক ঘণ্টার জায়গায় ৩ ঘণ্টা পানি দিতে হচ্ছে জমিতে। তেলের দাম বেশি, খরচ পড়ছে বেশি; পাশাপাশি সার পাওয়া যাচ্ছে না। সার পাওয়া গেলেও দামটা দিগুণের বেশি। ফলন কমে গেছে আগের চেয়ে অনেক। কারণ একদিন পানি না দিলে হয় না। যদি বেশি করে পানি দেন তাহলে আবার পচন ধরে।’
তুষভান্ডার ইউনিয়নের কাঞ্চনশ্বর এলাকার কৃষক সাইদুল ইসলাম বলেন, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবার সেচ খরচ বেশি পড়ছে। এ ছাড়া বীজসহ প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে।
সাইদুল ইসলামের মতো অন্য কৃষকরাও উৎপাদন খরচ নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারা বলছেন, প্রতিবছরই বোরো আবাদে খরচ বাড়ছে। তাই ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।
সংস্লিষ্টরা বলেন, মৌসুম শেষে ধানের উপযুক্ত দাম পাবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে কৃষক। এ জন্য সরকারিভাবে ধান-চালের বাজার তদারকিসহ ধান সংগ্রহ অভিযান জোরদার করতে হবে। অপরদিকে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ালে কৃষকের ব্যয় কমবে। এতে অনেকটা সাশ্রয় হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায় বলেন, কৃষিতে দিন দিন শ্রমিক সংকট হচ্ছে। এই এলাকার অধিকাংশ শ্রমিক দক্ষিণাঞ্চলে কাজ করতে যায়। তাই কৃষি যান্ত্রীকীকরনের বিকল্প নেই। এতে কৃষকের চাষাবাদে সাশ্রয় হবে। বোরো চাষে অতিরিক্ত সেচ লাগে। খরচ কমাতে কৃষকদের পরিমিত সেচ এবং নিয়ম মেনে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে বালাইকে দমন করার জন্য প্রয়োজনে কৃষকদের সবধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।